চিকিত্সার প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারের কথা বললেই শতভাগ ব্যক্তির মনে এক আশঙ্কা ও ভয়ের আগমন ঘটে।
প্রথমে অনুরোধ আসে, ওষুধে ভালো হবে না? পরের কথা, আর কদিন ওষুধ খেয়ে দেখি? অর্থাত্ সানন্দে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিত্সা নেওয়ার মানসিকতা কারোরই নেই।
জিজ্ঞেস করলে বলে, ভয় লাগে। কিসের ভয়? যদি জ্ঞান না ফেরে! এখনকার অ্যানেসথেসিয়ায় কারও জ্ঞান না ফেরার আশঙ্কা বিরল। ব্যথা হবে?
অস্ত্রোপচারের সময় টের পাবেন না, আবার পরে ব্যথা না হওয়ার ওষুধ দেওয়া হবে।
এত কিছু আলোচনার পরও ভয় থেকেই যায়। টেবিলে উঠে ইষ্ট-নাম জপে না, এমন লোক পাওয়া ভার। যেমন উড়োজাহাজে চড়ে বেল্ট বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ লোকই দোয়া-দরুদ পড়ে।
ভয়ের অন্যতম কারণ অসহায়ত্ব। অস্ত্রোপচারের সময় রোগী সম্পূর্ণভাবে অবেদনবিদ ও সার্জনের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে অবেদনবিদের ওপর তার জীবন-মরণ আর সার্জনের ওপর রোগমুক্তি। জীবিত অবস্থায় কোনো সময়ই আমরা নিজের নিয়ন্ত্রণ ছাড়ি না। মনে মনে সব সময়ই জানি, বিপদ হলে নিজেই উদ্ধারে ব্রতী হব। অস্ত্রোপচারের সময় একটা বিপত্সংকুল পথ সম্পূর্ণভাবে অন্যের ওপর নির্ভর করে পাড়ি দেওয়া উদ্বেগের অন্যতম কারণ।
সত্যি বলতে কি, আমরা যারা দীর্ঘদিন এ কাজে জড়িত, তারাও নিজেদের বা নিকটাত্মীয়দের বেলায় একটু ভেবে নিই।
এর পরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ৬০০ কোটি বিশ্ববাসীর মধ্যে বছরে ২৩ কোটির অস্ত্রোপচার হয়। এই বিশাল সংখ্যার প্রধান কারণ হচ্ছে, ভয় জয় করায় বৈজ্ঞানিক উন্নতি হয়েছে। অস্ত্রোপচার ও অ্যানেসথেসিয়ায় গত দুই দশকে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা এ দেশে এর প্রতিফলন দেখি। এখন অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে হাসপাতালে অনেক কম সময় থাকতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দিনে দিনেও অজ্ঞান করে অস্ত্রোপচারের পর বাড়ি ফেরা যায়।
অস্ত্রোপচার চলাকালে মৃত্যু এখন পাশ্চাত্যে লাখে এক; তাও অত্যন্ত বিপত্সংকুল ও নানা জটিল রোগে ভোগা রোগীদের বেলায়। মোটামুটি চলাফেরা করা সুস্থ রোগীদের বেলায় ১০ লাখে এক। আমরা অতটা উন্নতি না করলেও আমাদের পরিসংখ্যানও খুব খারাপ নয়।
অজ্ঞানসংক্রান্ত জটিলতায় মৃত্যুর ঘটনা উবে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্রশিক্ষিত অবেদনবিদ, রোগীর অবস্থা নিরূপণের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং আগাম পরীক্ষা করে রোগীর অজ্ঞান হওয়ার ক্ষমতা নিরূপণ।
এ কারণেই কোনো রোগীর অ্যানেসথেসিয়ার আগে তার শারীরিক পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে ল্যাবরেটরি পরীক্ষা প্রয়োজন। অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর অবস্থা নিরূপণের পর্যবেক্ষণ এখন অনেকটা ফুলপ্রুফ অবস্থায় এসে গেছে।
শরীরের কার্যাবলি—হূিপণ্ড, ফুসফুস, কিডনির তাত্ক্ষণিক চলমান অবস্থা যাচাইয়ের যন্ত্রপাতি আমাদের দেশেই এসে গেছে। চোখ-কান খোলা অবেদনবিদকে এখন আর কোনো অজানা আশঙ্কায় থাকতে হয় না। স্বাভাবিকের ব্যতিক্রম হলেই ব্যবস্থা নিয়ে রোগীকে বিপদমুক্ত করা যায়।
বর্তমানে অর্ধেক অবশ (স্পাইনাল অ্যানেসথেসিয়া) এক বহুল ব্যবহূত প্রক্রিয়া। নাভির নিচের সব অস্ত্রোপচারই এখন এ ব্যবস্থায় হয়। এ ক্ষেত্রে রোগী জেগে থাকে, কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না। বহুল প্রচলিত সিজার (বাচ্চা হওয়ার জন্য) এই অ্যানেসথেসিয়ায়ই হয়। জেগে থাকে বলে রোগীর কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা বেশি। তবে এ প্রক্রিয়ায়ও সঠিক পর্যবেক্ষণ ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার অভাবে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। প্রশিক্ষিত অবেদনবিদ ও উপযুক্ত পরিবেশই কেবল নিরাপদ অস্ত্রোপচারের অবিচ্ছেদ্য উপকরণ। অস্ত্রোপচারে ভয় পাওয়ার অন্যতম কারণ অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ব্যথা। এ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, ব্যথা সহনীয় পর্যায়ে রাখার অনেক ওষুধ এখন সহজলভ্য। আগে ব্যথার ওষুধ নিয়ে অনেকে ইতস্তত ছিল। এখন এসব ভুল ধারণা পাল্টে গেছে।
শেষ কথা
অস্ত্রোপচারের ভয় জয় করবে আপামর সেবাদানকারী অবেদনবিদ ও সার্জনের যোগ্যতা এবং অস্ত্রোপচার থিয়েটারের পরিবেশ। শুধু জেনে নিন, অবেদনবিদ উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কি না; ওই হাসপাতালের ওটিতে অ্যানেসথেসিয়ারত অবস্থায় পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (বিপি মেশিন, পাল্স অক্সিমিটার ইত্যাদি) বিদ্যমান কি না। সুষ্ঠু সেবা দিলে অস্ত্রোপচার আপনার জন্য এক সুখকর অনুভূতি হতে পারে।
খলিলুর রহমান
অবেদনবিদ, সাবেক অধ্যাপক
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১১, ২০০৯