বেলাল সাহেব হঠাত্ করেই মেঝেতে শুয়ে পড়লেন। অসুস্থ বোধ করছিলেন, বুক ধড়ফড় করছিল। তাঁর ঘাম দিয়ে শরীর যেন অবশ করে নেয়। দৌড়ে এসে তাঁর বড় মেয়ে অবস্থাটা বুঝতে পেরে কয়েক চামচ চিনি পানিতে গুলে খাইয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর তিনি সুস্থ হয়ে বসেন।
বেলাল সাহেব ডায়াবেটিসের রোগী। প্রতিদিন সকাল-বিকেল ইনসুলিন নেন। আজকে এর মাত্রা বেশি হওয়ায় তাঁর রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা বেশি কমে যাওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হয় হাইপোগ্লাইসেমিয়া।
একজন ডায়াবেটিক রোগীর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। প্রতিটি সমস্যাই বিশেষ বিবেচনায় আনতে হবে। দেখা যায়, অতিমাত্রায় রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে গেছে, যাকে বলি হাইপারগ্লাইসেমিয়া, তখন পেটে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে আসতে পারে। বমি হতে পারে। অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। তেমনি গরমের দিনে রোগী প্রচণ্ড ঘেমে এলেও চিকিত্সকের মাথায় রাখতে হবে স্বাভাবিক পরিমাণের চেয়ে অধিক মাত্রায় রক্তের গ্লুকোজ কমে গেল কি না। আর এই সঠিক সমস্যাগুলো ধরতে না পারলে রোগীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে।
রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ খুব বেশি কমে গেলে অর্থাত্ রক্তের প্রতি লিটারে ২ দশমিক ৫ মিলিমোলের নিচে হলে এবং সঙ্গে সঙ্গে রোগীর কিছু উপসর্গ প্রকাশ পেলে কিংবা উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার পরপর চিনি বা শর্করা খাওয়ালে যদি উপসর্গগুলো কমে আসে এবং রোগী সুস্থ বোধ করে, তখনই বলা যাবে রোগীর এ অবস্থাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের রোগীরাই হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়। দেখা যায়, রোগী সকালে বা বিকেলে ইনসুলিন ইনজেকশন নিয়ে বেরুনোর জন্য তাড়াহুড়ো করে। ঠিক সেই সময়ে পরিমাণমতো খাবার খেল না কিংবা খেতে বেশি বিলম্ব করল, তাতে এ সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। আবার দেখা যায়, ইনসুলিনের মাত্রা পরিমাণের চেয়ে বেশি নিল, তাতেও সমস্যা। কখনো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার দীর্ঘমেয়াদি বড়ি অনিয়মিত খেতে থাকলে হতে পারে এ সমস্যা বা ডায়াবেটিক রোগীরা হঠাত্ করে বেশি পরিশ্রম বা ব্যায়াম করলেও হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
ডায়াবেটিক রোগী নয়, এমন কেউ বেশিক্ষণ ধরে খাবার না খেলে রক্তে গ্লুকোজ কমার উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যা খেলে তাড়াতাড়ি হ্রাস পায়।
এ সমস্যায় আক্রান্ত হলে রোগীর কিছু উপসর্গ প্রকাশ পায়, যেমন হঠাত্ করেই রোগী অসুস্থ বোধ হচ্ছে এ কথা বলতে পারে কিংবা কোনো কাজে তার মন বসছে না, ছটফট ভাব আসে, বুক হঠাত্ করেই ধড়ফড় করতে থাকে, বুক কাঁপতে থাকে—রোগী এগুলো বলতে থাকে। মনে হয়, রোগীর ভীষণ ক্ষিধে পায়। পরক্ষণেই সারা দেহ ঘামতে শুরু করে। রোগী কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ ও কথাবার্তা বলতে শুরু করে। খিটখিটে মেজাজ দেখায়। পরক্ষণেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
এখানে জানা প্রয়োজন যে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অত্যধিক বেড়ে গেলেও রোগী একসময় অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এটা কি হাইপোগ্লাইসেমিয়া, নাকি হাইপারগ্লাইসেমিয়ার কারণে—তা বুঝতে হবে।
যে কারণেই হোক না কেন, বিলম্ব না করে রোগীকে ছয়-সাত চামচ চিনির পানি খাইয়ে দিতে হবে। কারণ, রক্তে গ্লুকোজ বেশি কমে যাওয়া এক ভয়াবহ সমস্যা।
এর কারণে রোগীর মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি মানসিক প্রতিবন্ধকতাও দেখা দেয় চিরতরে। সুতরাং হাইপোগ্লাইসেমিয়াই বেশি বিপজ্জনক। বেলাল সাহেবের বড় মেয়ে ঠিক কাজটিই করেছেন। ডায়াবেটিসের রোগী হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ ধরা মাত্রই চা-চামচের ছয় থেকে আট চামচ চিনি এক গ্লাস পানিতে গুলিয়ে খাইয়ে দিতে হবে। উপসর্গ চলে যাবে। বিপজ্জনক অবস্থায় পড়তে হবে না। যদি চিনি না পাওয়া যায়, তবে মিষ্টি দিতে পারেন। কখনো আখের রস কিংবা ডেক্সট্রোজ। ঘরে মধু থাকলে তাও দেওয়া যায়।
কিন্তু রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে মুখে খাওয়ানো কষ্টকর। তখন দেহের শিরায় ২৫ শতাংশ গ্লুকোজ ইনজেকশন প্রায় ৫০ এমএল দ্রুত দিতে হয়। এমনও হতে পারে, শিরা পাওয়া যাচ্ছে না। বিলম্ব না করে নাকে নল ঢুকিয়ে তারপর চিনি বা গ্লুকোজ খাওয়ানো যেতে পারে। কোনোভাবেই রোগীকে চিনি, গ্লুকোজ বা মধু খাওয়ানো সম্ভব না হলে তখন চিকিত্সকেরা মুখের মিউকোসাতে মধু ঘষতে থাকেন কিংবা পানির সঙ্গে মধু মিশিয়ে পায়ুপথে দেওয়া যায়।
এসব চিকিত্সার ফলে রোগীর কয়েক মিনিটের মধ্যে এ রোগের উপসর্গগুলো হ্রাস পায়। রোগীর জ্ঞান ফিরে আসে। রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ বোধ করে। পরবর্তী সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে। ইনসুলিন নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
ডা. এস কে অপু
হূদরোগ বিশেষজ্ঞ