হৃদযন্ত্র ও অন্যান্য দেহযন্ত্র নিয়ে যত কথা হয়, কিডনি নিয়ে তত কথা হয় না, শরীরের নানা কাজে এদের অবদান যে কত, ভাবা যায় না।
শরীর সুস্থ রাখার জন্য কিডনির ভূমিকা অনস্বীকার্য। যদিও শরীরের নানা জঞ্জাল ও বাতিল তরল কিডনি বের করে দেয়। কিডনি ঠিকমতো কাজ না করলে বিষাক্ত জিনিস শরীরে জমে জমে অসুস্থ হয় হূদযন্ত্র ও ফুসফুস। শরীরে পানি জমে, হয় শ্বাসকষ্ট। আমাদের শরীরে রয়েছে দুটো কিডনি। শিমের বীচির মতো দেখতে, ওজন ১৫০ গ্রাম, আয়তনে ১২x৫ সেন্টিমিটার। পিঠের মাঝখানে পাঁজরের খাঁচার নিচে এদের অবস্থান। প্রতিটি কিডনি অনেকগুলো খুবই ছোট, অথচ জটিল একক নিয়ে গঠিত, এই এককের নাম হলো নেফ্রোন। প্রতিটি নেফ্রোনের কাজ হলো প্রস্রাব তৈরি করা আর এভাবে রক্ত থাকে বিষমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন।
স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন ২০০ লিটার পানি কিডনি দিয়ে পরিশ্রুত হয়, তবে মাত্র দুই থেকে তিন লিটার প্রস্রাব বেরিয়ে যায় দৈনিক; প্রস্রাবে থাকে বর্জ্য ও অম্ল।
শরীরের যা অপ্রয়োজনীয়, কিডনি তা বের করে দেয় অথচ শরীরে ফিরিয়ে দেয় এমন সব জিনিস, যা শরীরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনীয় জিনিস বাছাই করে শরীরের জন্য সংরক্ষণ করার এ কাজে কিডনির জুড়ি নেই। এ ছাড়া আরও কাজ আছে। কিডনি শরীরকে লোহিত কণিকা তৈরির কাজে সহায়তা করে। নিয়ন্ত্রণ করে রক্তচাপ। ভিটামিন ডি সক্রিয়রূপে পরিণত হয় কিডনিতেই। আর এ জন্য কিডনির কল্যাণে হাড় থাকে মজবুত। শরীরে অম্ল ও ক্ষারের সমতা রক্ষায় কিডনির ভূমিকা রয়েছে।
লোহিত কণিকা গঠনে কিডনির ভূমিকা নিয়ে আরও বিস্তারিত বলি।
কিডনি, লোহিত কণিকা গঠন, রক্তচাপ ও সুস্থ হাড়এদের মধ্যে পরস্পর সম্পর্ক বেশ জটিল।
কিডনি থেকে তৈরি হয় একটি হরমোন, যার নাম হলো ইরিথ্রোপয়টিন। এই হরমোন অস্থিমজ্জাকে উদ্দীপিত করে লোহিত কণিকা গঠনের জন্য। কারও কিডনি বিকল হলে কিডনি থেকে তৈরি হয় না ইরিথ্রোপয়টিন। ফলে হাড় লোহিত কণিকা তৈরি করতে পারে না, আর রোগীর হয় রক্তশূন্যতা।
দ্বিতীয়ত, বয়স বেশি হলে, ৪০ পেরোলে, লবণ কম খেতে হয়, যাতে রক্তচাপ থাকে সীমার মধ্যে।
কিডনি বাড়তি লবণ মোকাবিলা করতে পারে না, আর তাই বেশি লবণ খেলে বেশি পানি শরীরে থেকে যায় আর তাই রক্তচাপ যায় বেড়ে। বাড়ে শরীরের তরল। সুস্থ হাড়ের জন্য চাই সুস্থ কিডনি।
ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ডি ও প্যারাথাইরয়েড হরমোনের একটি জটিল সমন্বয় ও কাজকর্মকে মোকাবিলা করে কিডনি। হাড় থাকে সুস্থ ও সবল।
কিডনি বিকল হলে এই সমন্বিত কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটে, আর তখন হাড় হয়ে পড়ে ভঙ্গুর।
কিডনি-সমস্যার মূল কারণ কী কী তাহলে?
তালিকার প্রথমে রয়েছে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করলে কিডনির হয় অনেক ক্ষতি, আর একটি কথাযাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের তেমন উপসর্গ থাকে না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে ডায়াবেটিস এত বেশি আর উপসর্গও তেমন হয় না, সে জন্য অনেক রোগী আসে ডায়াবেটিসের কারণে কিডনি রোগ নিয়ে। ইতিমধ্যে ডায়াবেটিস কিডনির ক্ষতি করতে শুরু করেছে, আর বিকল হওয়ার পথে কিডনির যাত্রাও শুরু হয়েছে। কিডনি রোগের আরেকটি কারণ হলো সংক্রমণ ও প্রদাহ। বড় কারণ হলো ই.কোলাই নামের জীবাণুর সংক্রমণ। ই.কোলাই ব্যাকটেরিয়া এমনিতে থাকে পাচকনলে, মেয়েদের মূত্রনালিপথে এরা চলে যায়, যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের ভোগান্তি অনেক। এই ব্যাকটেরিয়া তখন উঠতে থাকে ওপর দিকে। শিশু ও বৃদ্ধলোক যাদের মূত্রপথে থাকে অবরোধ, তাদেরও সে রকম সংক্রমণ হতে পারে।
প্রদাহ হওয়ার অনেক কারণ অজানা। তবে ভাইরাস সংক্রমণ এবং অনেক অটোইম্যুন রোগ ঘটাতে পারে প্রদাহ।
কিডনি পাথুরি হলেও কিডনি পরে অসুস্থ হতে পারে।
কিডনি রোগ প্রতিরোধ বড় জরুরি। সংক্রমণ, প্রদাহ, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের জন্য কিডনিতে একবার ক্ষত হলে একে খণ্ডানো কঠিন, এ চলতেই থাকে সামনের দিকে।
কিডনি এক বিস্ময়কর যন্ত্র। একটি নয়, আমাদের রয়েছে দুটো কিডনি। প্রচলিত কথা One to care and one to share। মাত্র একটি কিডনি দিয়েও জীবনধারণ সম্ভব।
পৃথিবীতে অসংখ্য লোক রয়েছেন, যাঁরা স্বজনদের বা অন্যদের একটি কিডনি দান করে বেশ সুস্থ আছেন দীর্ঘদিন।
তবে কিডনি যখন অসুস্থ হয়, দুটোরই ক্ষতি হয়। কোনো টিউমার বা অবরোধ বা পাথুরি, যা একটি কিডনিতে সীমাবদ্ধ। সে ক্ষেত্রে ছাড়া অন্যান্য রোগে দুটো কিডনিতেই রোগের প্রভাব পড়ে।
প্রতিরোধক ধাপ
রক্তচাপ নিয়মিত মাপাবেন।
মাঝেমধ্যে রক্তে ক্রিয়েটিনিন মান মাপাবেন। (কিডনি কত ভালো কাজ করছে, এর একটি সূচক হলো কিয়েটিনিন)
পারিবারিক চিকিৎসকের পরামর্শমতো নির্ভরযোগ্য ল্যাবে প্রস্রাব ও রক্তের সম্পূর্ণ পরীক্ষা করাবেন। তাহলে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য সমস্যা থাকলে আগে ধরা পড়বে।
বেশি ওজন, স্থূলতা ও জীবনযাপনের রোগগুলো এড়াতে ব্যায়াম করতে হবে নিয়মিত।
ফাস্টফুড, হিমায়িত খাবার, আচার, পাপড়, অন্যান্য নোনা খাবার বর্জন করতে হবে।
আচার যত কম খাওয়া যাবে, তত ভালো। হয়তো মাসে, দুই মাসে এক দিন।
কিডনি রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে চেকআপ আগে শুরু করতে হবে এবং নিয়মিত।
প্রচুর পানি পান করতে হবে, যাঁরা ঘরের বাইরে রোদে কাজ করেন, তাঁরা পান করবেন অনেক বেশি।
খাদ্যে লবণ কম খেলে বেশির ভাগ ক্যালসিয়াম পাথুরি রোধ করা যায়।
নারীদের গোপনাঙ্গ সামনে থেকে পেছন দিকে ধুতে হবে, তা না হলে পাচকনলের ই.কোলাই জীবাণু মলদ্বার থেকে মূত্রপথে প্রবেশ করতে পারে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ৩০, ২০১০