সহস্রাব্দ লক্ষ্যের প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে মায়েদের স্বাস্থ্য এবং শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন। এত সব প্রচেষ্টা এবং প্রচার-প্রচারণার ভিড়ে বাবা বা পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়টি আমরা অবহেলা করছি কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কারণ, মহিলা ও শিশুদের বিষয়ে সবাই যতটা সহানুভূতি এবং আগ্রহসহকারে স্বাস্থ্যসমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করেন, বাড়ির কর্তাটির কথা সেখানে আজকাল অনেক সময় কারও মনে থাকে না।
পুরুষদের স্বাস্থ্যসমস্যা কী? সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র পুরুষদের স্বাস্থ্যসমস্যার একটি তালিকা করেছে। সেই তালিকাটি কিন্তু অবাক করার মতো ছোট। সেখানে পুরুষদের শত্রু হিসেবে প্রধান সাতটি রোগ-ব্যাধিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সাতটি রোগ-ব্যাধির প্রতি নজর দিলে এবং প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে পুরুষ প্রজাতির সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যাবে বলে আশা করা যায়।
হূদরোগ
পুরুষদের প্রধান শত্রু হূদরোগ। অতএব সব পুরুষকে হূদরোগ প্রতিরোধ করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। এ জন্য—
ধূমপান পরিহার করতে হবে। হূৎপিণ্ডের অন্যতম প্রধান শত্রু ধূমপান। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ধূমপান পরিত্যাগ করতে হবে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ। শাকসবজি, ফলমূল, আকাড়া শস্যদানা, অতিরিক্ত আঁশযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে। পরিহার করতে হবে সম্পৃক্ত চর্বি এবং লবণযুক্ত খাবার।
ক্রনিক রোগ পরিহার করতে হবে। যেমন উচ্চরক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিস হলে অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা।
প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে। যেকোনো ধরনের শরীরচর্চা কিংবা খেলাধুলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
শরীরের ওজন সীমিত রাখতে হবে। অতিরিক্ত ওজন মানেই হূৎপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত বোঝা।
মদ্যপান পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং তা হূৎপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর।
মানসিক চাপ ও উদ্বেগমুক্ত হতে হবে।
ক্যানসার
হূদরোগের পরে পুরুষের দ্বিতীয় প্রধান শত্রু ক্যানসার। ফুসফুস, ত্বক, প্রোস্টেট, অন্ত্র ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্যানসারে বহু পুরুষের অকালমৃত্যু হয়। ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো বেশ কার্যকরী।
ধূমপান পরিহার। ধূমপান পরিহার করলে যেমন হূদরোগের আশঙ্কা কমে, তেমনি ক্যানসারের ঝুঁকিও কমে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অতিরিক্ত ওজন কমাতে পারলে নানা ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে।
ব্যায়াম করতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা ওজন কমাতে সাহায্য করে, একইভাবে ক্যানসারের ঝুঁকিও কমায়।
প্রচুর শাকসবজি এবং ফলমূল খেতে হবে। শাকসবজি এবং ফলমূল ক্যানসার প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী।
অতিরিক্ত সৌর আলোক ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। সূর্যের আলোতে অতিরিক্ত ঘোরাঘুরি করলে অবশ্যই সানস্ক্রিন ক্রিম কিংবা ছাতা ব্যবহার করা উচিত।
মদ্যপান পরিত্যাগ করতে হবে। অতিরিক্ত মদ্যপান করলে অন্ত্র, ফুসফুস, কিডনি, যকৃৎ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কিছুু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসার সুপ্তাবস্থায় বা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যায়। এ জন্য প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
দুর্ঘটনাজনিত স্বাস্থ্যসমস্যা
মোটর-যানবাহন দুর্ঘটনা পুরুষদের মৃত্যুর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। অতএব পথেঘাটে চলাফেরার সময় সতর্ক থাকতে হবে। যানবাহন ব্যবহারের সময় মাথায় হেলমেট পরা এবং সিটবেল্ট বাঁধা গুরুত্বপূর্ণ। মদ্যপান কিংবা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যানবাহন চালানো একদম উচিত নয়।
ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি অবরোধাত্মক ব্যাধি
ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগে অনেক পুরুষের স্বাস্থ্য হানি হয়ে থাকে। বিশেষ করে ক্রনিক ব্রংকাইটিস ও পালমোনারি এসফিসিমায় অনেক পুরুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে থাকে। এ জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত—
ধূমপান পরিহার করতে হবে। ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগের প্রধান কারণ ধূমপান। ধূমপান পরিহার করলে এর থেকে মুক্ত থাকা সহজ হবে।
বায়ুদূষণ পরিহার করতে হবে। এড়িয়ে চলতে হবে ধুলাবালি-ধোঁয়াযুক্ত পরিবেশ।
শ্বাসনালির সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হবে। ঘন ঘন শ্বাসনালির সংক্রমণ দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগের প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। অতএব শ্বাসনালির সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকার জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত বা স্ট্রোক
মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত ঝুঁকির অনেক উপাদান আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, জাতি ইত্যাদি। কিন্তু কতগুলো উপাদান নিয়ন্ত্রণযোগ্য। যেমন—
ক্রনিক রোগসমূহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ইত্যাদি পক্ষাঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ধূমপান পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত ধূমপান পক্ষাঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। মদ্যপান পরিহার করে আমরা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে পারি।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস, বিশেষ করে টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকলে শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে হূদরোগ, চোখের রেটিনার সমস্যা, স্নায়ুরোগ এবং আরও অনেক জটিলতা দেখা দেয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অধিকাংশ পুরুষ তাঁদের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারেন। এ জন্য—
নিয়মিত জীবনাচরণ মেনে চলতে হবে।
গ্রহণ করতে হবে স্বাস্থ্যকর খাদ্য।
ব্যায়াম করতে হবে নিয়মিত।
কমাতে হবে অতিরিক্ত ওজন ।
আত্মহত্যা প্রবণতা
পুরুষের স্বাস্থ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আত্মহত্যা-প্রবণতা। সাধারণত বিষণ্নতা থেকে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগে। কারও বিষণ্নতার লক্ষণ-উপসর্গ দেখা গেলে অবশ্যই তার চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে বিষণ্নতা দূর করার মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সবশেষে বলতে হয়, পুরুষদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল সূত্রটি একই—স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো। এর সুফল আমরা যা কল্পনা করি, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
এ আর এম সাইফুদ্দীন একরাম
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন বিভাগ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৮, ২০১১