জন্মের পর প্রত্যেক বাচ্চার জন্ডিস হয়। বাচ্চার যখন তিনদিন বয়স, তখনই এর শুরু। কখনো আবার দুদিনের মাথায়ও এটা হতে পারে। সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে এটা আপনা থেকেই ঠিক হয়ে যায়। এ ধরনের জন্ডিসের নাম ‘ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস’। সদ্যোজাত শিশুদের বিলিরুবিনের পরিমাণ খুব বেশি থাকে। কেননা যকৃতের যে উৎসেচক বা এনজাইমগুলোর বিলিরুবিন নিয়ন্ত্রণ করার কথা, সেগুলো শিশুর জন্মের অব্যবহিত পরেই তাদের কাজ ঠিকমত শুরু করে উঠতে পারে না। এটাই হলে ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসের কারণ।
ব্রেস্ট মিল্ক জন্ডিস ঃ বাচ্চাদের আরেক ধরনের জন্ডিস হলো ব্রেস্ট মিল্ক জন্ডিস। মায়ের দুধে এমন একটা হরমোন থাকে, যা থেকে শিশুর শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা খুব বেশি হয়ে যায়। এ ধরনের জন্ডিস অনেক বাচ্চারই হতে দেখা গেছে। মাঝে-মধ্যে এক থেকে দু’মাস এটা থাকে। শিশু হাসপাতালে থাকার সময়ে এটা ধরা পড়লে অতিবেগুনি রশ্মি বা আলট্রা ভায়োলেটরে’র নিচে তাকে রাখা হয়। অনেক সময় অবশ্য বাচ্চা বাড়ি চলে যাওয়ার পর এই জন্ডিস ধরা পড়ে। সেক্ষেত্রে সূর্যের আলোয় বাচ্চাকে শুইয়ে রাখতে বলা হয়। এ দুটি উপায়ে এ ধরনের জন্ডিসের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে।
রেশাস ইনকমপ্যাটিবিলিটি ঃ বাচ্চাদের জন্ডিসের মধ্যে সবচেয়ে জটিল বোধহয় রেশাস ইনকমপ্যাটিবিলিটি। মায়ের ব্লাড গ্রুপের সঙ্গে শিশুর ব্লাড গ্রুপ না মিললে অনেক সময় এই জন্ডিস শিশুর দেহে দেখা দেয়। জন্মের দিন থেকেই বাচ্চার এই জন্ডিস হয় এবং সেদিন থেকেই এর চিকিৎসা শুরু হওয়া দরকার। গর্ভাবস্থায় আগে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালেই কিন্তু বাচ্চা জন্মানোর আগেই বোঝা সম্ভব, তার এ ধরনের জন্ডিস হবে কিনা। সেক্ষেত্রে চিকিৎসারই সুবিধা হয়। এমনিতে এই জন্ডিস কমের মধ্যে থাকলে ফোটোথেরাপি দিয়েই সারানো সম্ভব। তা না হলে জন্ডিসের তীব্রতা খুব বেশি হলে শেষ বিকল্প হিসেবে ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা বাচ্চা পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছে, ততক্ষণ তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয় না। বাড়িতে রেখে এই জন্ডিসের চিকিৎসা সম্ভব নয়।
অবস্ট্রাকশন ঃ অবস্ট্রাকশন বা শরীরের কোথাও কোনো বাঁধা থাকলে তা থেকে যে জন্ডিস হয়, বাচ্চাদের বেলায় সেই জন্ডিস কিন্তু মারাত্মক। কারণ এটা প্রথমে হঠাৎ বোঝা যায় না। ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসের সঙ্গে এই জন্ডিসের পার্থক্য নিরূপণ করা মুশকিল। কিন্তু ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস ১০ দিনের মধ্যেই সেরে যাওয়ার কথা। যদি এরকম হয়, দু’সপ্তাহের মধ্যে জন্ডিস সারছে না, তাহলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করান। অবস্ট্রাকশনের দরুন জন্ডিস হলে বাচ্চার পায়খানার রং সাদা হবে। তাছাড়া গায়ের রংও একটু বেশি হলুদ হতে পারে। মনে রাখবেন, এই জন্ডিস শিশুর এক থেকে দেড় মাস বয়সের মধ্যে ধরা পড়া খুব জরুরি। কারণ সে সময়ের মধ্যেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ওই অবস্ট্রাকশন, যার জন্য জন্ডিস হচ্ছে, তা সরিয়ে ফেলতে হবে। এটা নিয়মের ব্যতিক্রম বলেই ধরে নিতে হবে।
অন্যান্য কারণে : আরো কিছু কারণে জন্ডিস হতে পারে। যেমন হাইপোথাইরয়েডের জন্যও জন্ডিস হয়। জন্মের পাঁচ থেকে সাত দিনের মাথায় এটা হয়। হাইপোথাইরয়েডের জন্ডিস দেরি করে শুরু হয়, দেরি করে শেষ হয়। আবার প্রি-ম্যাচিওর বেবি এবং ছোট সাইজের বাচ্চাদের মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে।
এবার জন্ডিসের ধরন। এ বি সি এ- সব ধরনের জন্ডিসই বাচ্চাদের হতে পারে। ‘এ’ আর ‘ই’ ধরনের জন্ডিস খাদ্য এবং পানীয় থেকে সংক্রমণের ফলেই সাধারণত হয়। আর হেপাটাইটিস ‘বি’ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। মায়ের তা থাকলে বাচ্চা জন্মের সময়ই ‘বি’ টাইপ জন্ডিসের সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে। তাছাড়া বাচ্চার শরীরে রক্ত দিলে হাসপাতাল থেকে বিভিন্ন সংক্রমণের ফলেও এটা হতে পারে। হেপাটাইটিস ‘বি’র আরো একটি কারণ আছে। তবে সে কারণ সম্পর্কে এখনো নির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব হয়নি। আর বাড়ির বাচ্চার হেপাটাইটিস ‘বি’ হলে বাড়ির সবাইকে এর টিকা নিতে হবে। হেপাটাইটিস ‘বি’র ভ্যাকসিন বা টিকা আছে। হেপাটাইটিস ‘সি’র কিন্তু সেরকম কিছু নেই। তাই এটা খুব ভয়ের। আবার অনেক সময় এক-দু’বছরের বাচ্চাদের জন্ডিস যে হয়েছে, তা বোঝা যায় না। ‘এ’ বা ‘ই’ টাইপ জন্ডিস হলে সেরকম ঝামেলা হয়তো হবে না; কিন্তু এরকম অজান্তে যদি বি বা সি টাইপ জন্ডিস হয়, তাহলে কিন্তু প্রাণসংশয়ও হতে পারে।
ডা. ওয়ানাইজা
চেম্বার : জেনারেল মেডিক্যাল হাসপাতাল (প্রা.) লি., ১০৩, এলিফ্যান্ট রোড (তৃতীয় তলা), বাটা সিগন্যালের পশ্চিম দিকে, ঢাকা, ফোন : ০১৯১১৫৬৬৮৪২।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, আগস্ট ২২, ২০০৯