জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছু আমরা মনে রাখতে পারি না। অনেক কিছুই ভুলে যাই, আবার অনেক কিছু মনেও থেকে যায়। অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া গুরুত্বহীন কোনো ঘটনা মনে না থাকাই স্বাভাবিক। আবার সকালে কী দিয়ে নাশতা করেছি, সেটা রাত অবধি মনে রাখা অথবা প্রিয় বন্ধুর ফোন নম্বরটি আমরা সহজেই মনে রাখতে পারি।
বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অথবা শরীর ও মনের কোনো অসুস্থতার কারণে এ স্বাভাবিক মনে রাখার ক্ষমতা ক্রমশ কমে যাওয়াটাই ভুলে যাওয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগ (ডিমেনশিয়া)। এ রোগে নিকট বা দূরঅতীত অথবা উভয় ধরনের ্নৃতি কমে যাওয়ার পাশাপাশি নতুন কিছু শিখতে না পারা, বুদ্ধিমত্তা কমে যাওয়া, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ও জীবনযাপনের মান কমে যায়। বয়সের সঙ্গে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে সাধারণত ৬৫ থেকে ৭৫-এর মধ্যে ৫-৮ শতাংশ, ৭৫ থেকে ৮৫-এর মধ্যে ১৫-২০ শতাংশ এবং ৮৫ বছর বয়সের ওপরে ২৫-৫০ শতাংশ।
মস্তিষ্কের বাইরের অংশ (করটেক্স) অথবা করটেক্স-পরবর্তী অংশের (সাব-করটিকাল) পরিবর্তনজনিত কারণে ভুলে যাওয়ার সমস্যা হতে পারে। আর এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে কারণে ভুলে যাওয়া রোগ হতে পারে তা হচ্ছে আলঝেইমারস রোগ। এ ছাড়া বারবার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) হওয়া, সিফিলিস, ক্রুজফোল্ড জ্যাকব রোগ, পারকিনসনস রোগ, হান্টিংটন, এইডস, নরমাল প্রেসার হাইড্রোক্যাফালাস, মাল্টিপল লেরোসিস কিংবা থাইরয়েড হরমোনের কম নিঃসরণের কারণেও ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাওয়া রোগ হতে পারে।
বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে মস্তিষ্কের স্মায়ুকোষগুলোর ক্ষয়জনিত পরিবর্তন হতে থাকে। ফলে মনে রাখার ক্ষমতাও কমে যায়। আলঝেইমারসে মস্তিষ্কের আকার ছোট হয়ে যায়, মস্তিষ্কের মধ্যকার ভেনট্রিকল বা প্রকোষ্ঠ বড় হয়ে যায়, মস্তিষ্কের ভাঁজগুলো সমান হয়ে যেতে থাকে। ‘বিটা এ ফোর’জাতীয় প্রোটিন মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষের সঙ্গে মিলে তৈরি করে অ্যামাইলয়েড প্লাক আর ‘টাউ’ প্রোটিন দিয়ে গঠিত এক ধরনের ক্ষুদ্র জটও তৈরি হয়ে থাকে আলঝেইমারস রোগে।
এ ছাড়া করটেক্স ও হিপ্পোক্যাম্পাস এলাকায় স্মায়ুকোষের ক্ষয় হয়ে থাকে। স্মৃতি-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত মস্তিষ্কের বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণগত তারতম্য দেখা যায়। ফলাফল দাঁড়ায় রোগীর স্মরণশক্তির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবনতি। শুধু মনে রাখতে না পারার লক্ষণ নিয়ে নয়, বরং আরও নানা রকম লক্ষণ নিয়ে ডিমেনশিয়া প্রকাশ পেতে পারে; প্রকারভেদে লক্ষণ বিভিন্ন রকম হলেও সাধারণ যে লক্ষণগুলো বেশি দেখা যায় তা হলো-
স্মরণশক্তি কমে যাওয়া
এতে একদিকে যেমন অতীত স্মৃতি হারিয়ে যেতে পারে, তেমনি নতুন করে কোনো কিছু শিখতে কষ্ট হয়।
সংবেদনের মাধ্যমে কোনো বস্তু বা ভাবনা সম্পর্কে ধারণা এবং তা প্রকাশ করার ক্ষমতা কমে যাওয়া
যেমন, হতে পারে এফাশিয়া, যেখানে কথা বলার ক্ষমতা নষ্ট হয় বা অন্যের কথা শুনলেও তা বোঝার ক্ষমতা থাকে না। অ্যাগনোশিয়া হতে পারে, যেখানে কোনো পূর্বপরিচিত বস্তুকে দেখে, শুনে বা স্পর্শ করেও তা শনাক্ত করতে পারে না ডিমেনশিয়ার রোগী আর এপ্রাক্সিয়া হলে অতিপরিচিত বহুবার করা কাজ-যেমন দাঁত ব্রাশ, শার্টের বোতাম লাগানো প্রভৃতি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রান্না করা, গাড়ি চালানো প্রভৃতি অভ্যাসজনিত শিক্ষাও ভুলে যেতে পারে।
আচরণ পরিবর্তন
অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি। যেমন ঘরের এক জায়গার জিনিস আরেক জায়গায় রেখে দেওয়া, চুরি করা, ছোটখাটো অপরাধ করা, যেখানে সেখানে প্রস্রাব করে দেওয়া, অস্বাভাবিক যৌন আচরণ করা ইত্যাদি।
ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন
রাশভারী লোক এ রোগে আক্রান্ত হলে ছেলেমানুষের মতো আচরণ করতে পারে, আবার মিশুক ব্যক্তি হয়ে যেতে পারে ঘরকুনো।
আবেগের পরিবর্তন
হঠাৎ কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই খুশি হয়ে যাওয়া অথবা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে ডিমেনশিয়ার রোগীদের। অনেক সময় কেবল বিষণ্নতার লক্ষণ থাকতে পারে।
ভ্রান্ত বিশ্বাস
অনেক সময় একটা অমূলক ভ্রান্ত বিশ্বাস তীব্রভাবে পেয়ে বসে। কখনো নিজের খুব কাছের মানুষকেও অবিশ্বাস করতে শুরু করে, শত্রু ভাবতে থাকে।
সামাজিক কর্মকাণ্ড ও পেশাগত দক্ষতার ঘাটতি
কর্মদক্ষতা কমে বহুলাংশে। বইপত্র পড়তে না পারা, সময়মতো কোনো কাজ করতে না পারা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। ডিমেনশিয়া রোগীদের জন্য রয়েছে নানা রকম চিকিৎসাপদ্ধতি। কোনোটাতে ভুলে যাওয়ার গতির রাশ টেনে রাখা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগের কারণ বের করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়, কখনো আচরণ পরিবর্তনমূলক চিকিৎসা দেওয়া হয় আবার কখনো বা দৈনন্দিন কাজ চালানোর মতো বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ রোগের চিকিৎসায় রোগীর আত্মীয়-পরিজনদের ভূমিকা অনেক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কীভাবে তারা এ রোগীর সেবা করবে সে বিষয়ে তাদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
ডিমেনশিয়া চিকিৎসার সাধারণ পদ্ধতি
ডিমেনশিয়ার কারণ শনাক্ত করা এবং সেই কারণ দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান। থাইরয়েডের সমস্যা, পারকিনসনস রোগ ও সিফিলিস প্রভৃতি থাকলে উপযুক্ত চিকিৎসা করা। ভুলে যাওয়ার কারণে রোগীর সামাজিক ও পেশাগত দক্ষতা কমে গেলে কীভাবে রোগী ও তার পরিবারকে বিকল্প সুবিধা প্রদান করা যায় তার ব্যবস্থা করা। যেমন প্রয়োজনে তার পেশা পরিবর্তন করা লাগতে পারে।
রোগীর দৈনন্দিন কাজ (গোসল, খাওয়াদাওয়া প্রভৃতি) করার ক্ষমতা কমে যায় বলে এগুলো করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা ও অকুপেশনাল থেরাপির মাধ্যমে রোগীর কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করা।
রোগীর ব্যাংকিং ও অন্যান্য আর্থিক লেনদেনসহ আইনগত সমস্যার সমাধানেও চিকিৎসককে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে হয়। এ রোগের গতি আটকে বা ধীর করে দিয়ে রোগীর সংবেদনসংক্রান্ত দুর্বলতার উন্নতি ঘটাতে পারে এমন অনেক ওষুধ উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও এখন সহজলভ্য। তবে কোনোক্রমেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রত্যক্ষ পরামর্শ ছাড়া ডিমেনশিয়ার ওষুধ সেবন করা যাবে না। এ ছাড়া অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন-ই ইত্যাদি ওষুধও ইদানীং বিভিন্ন ধরনের ডিমেনশিয়াতে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, রোগী যেন কোনোভাবে সমাজবিচ্যুত না হয়ে যায় বা একাকিত্বে না ভোগে। তার জন্য একটি প্রাত্যহিক রুটিন তৈরি করা প্রয়োজন। তার গোসলখানা বা টয়লেটের দরজার বাইরে বড় লাল দাগ দিয়ে রাখা যেতে পারে, যাতে সহজেই সে চিনতে পারে দরজার হাতল। দেয়ালে ধরার জন্যও বিশেষ হাতল লাগানো যেতে পারে। গোসলখানায় কমোড বা বেসিন সামনের দিকে দেওয়া দরকার। আর গোসলের স্থানটা পেছনে দিতে হবে, যাতে মেঝে সব সময় শুকনো থাকে।
রোগীর স্বজনেরা তার সঙ্গে সময় কাটাবেন এবং তার যেকোনো ইতিবাচক কাজকে উৎসাহ দেবেন। ভুলের জন্য কোনোভাবেই তাকে দোষারোপ করা যাবে না; তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করা যাবে না। একটি শিশুকে যেভাবে লালনপালন করতে হয়, ডিমেনশিয়ার রোগীদের ঠিক সেভাবে যত্ন নিতে হবে। তার ভুলে যাওয়া কিছু কাজ, বিশেষ করে নিজের যত্ন নেওয়াটা নতুন করে শেখাতে হবে ও অভ্যাস করাতে হবে। বিষণ্নতা ও ঘুমের সমস্যার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে হবে।
দীর্ঘদিন ডিমেনশিয়ায় ভুগলে নিউমোনিয়াসহ নানা রকম সংক্রমণের শিকার হতে পারে রোগী; বিশেষত যাঁদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। তাই নিউমোনিয়া প্রতিরোধেও প্রয়োজনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ডিমেনশিয়া রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পরিজনদের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও করার আছে অনেক কিছু। সহায়ক সমিতি গঠন, বিশেষায়িত প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন, পুনর্বাসনকেন্দ্র ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের ধরে রাখা যায় সমাজের মূল স্রোতে।
ডা· আহমেদ হেলাল
সহকারী রেজিস্ট্রার
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২০, ২০০৮