১·
তারেক (ছদ্মনাম) আগে চাকরি করতেন ঢাকায় একটি টেলিফোন কোম্পানিতে। চলছিল ভালোই, কিন্তু একটা সুযোগ পেয়ে যোগ দিলেন আরেকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে। সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি, তবে কর্মস্থল চট্টগ্রামে। ওখানে গিয়ে সহকর্মীদের কেমন যেন মনে হলো তারেকের। তাঁর ওপর দীর্ঘদিনের চেনা ঢাকা শহর ছেড়ে চট্টগ্রামে চাকরি করা, থাকা। তাঁর মনটা সব সময় খারাপ হওয়া শুরু করল। কোনো কিছুতেই যেন আনন্দ পান না। মেজাজটাও হয়ে উঠল খিটখিটে। সব সময় একটা উৎকণ্ঠা। বাড়ির গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিলগুলো দিতে প্রায়ই ভুলে যান। গাড়ি চালাতে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। তুচ্ছ কারণে ঝাঁজিয়ে ওঠেন সহকর্মীদের সঙ্গে।
২·
সানিয়া (ছদ্মনাম) উচ্চশিক্ষিত মেয়ে। নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছেন মারুফকে (ছদ্মনাম)। মারুফও বেশ ভালো ছেলে। বিয়ের পর সানিয়া উঠে এসেছে মারুফদের বাড়িতে। সেখানে আছে মারুফের একমাত্র ছোট ভাই আর মা। আয়-রোজগার ভালো, কোনো ধরনের দাম্পত্য সমস্যা নেই। শাশুড়িও যথেষ্ট স্মেহ করেন। ছোট দেবরটিও ভালো, কিন্তু তার পরও সানিয়া দিন দিন বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছেন। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ফোনে ঠিকমতো কথা বলেন না। প্রায়ই মাথাব্যথা থাকে। আচরণগত সমস্যা তৈরি হয়েছে তাঁর মধ্যে। বিনা কারণে মারুফের সঙ্গে ঝগড়া আর কান্নাকাটি, শাশুড়ির সঙ্গে দুর্বøবহার, এমনকি মাঝেমধ্যে মরে যাওয়ারও ইচ্ছা হয় সানিয়ার। তারেক আর সানিয়ার এ ধরনের সমস্যাকে বলা হয় মানিয়ে চলার সমস্যা (অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার)। পরিবর্তিত বা নতুন পরিস্থিতি অথবা মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে আবেগের অস্বাভাবিক প্রকাশ আর আচরণের যে সমস্যা ঘটে, সেটাই মানিয়ে চলার সমস্যা। নতুন কর্মক্ষেত্র, অফিসে ঝামেলা, বিয়েবিচ্ছেদ, দীর্ঘমেয়াদি রোগ, অবসরগ্রহণ, নতুন স্কুলে ভর্তি, ব্যবসায় ক্ষতি হওয়া এমনকি চাকরিতে প্রমোশন বা নতুন বাবা-মা হওয়ার পরও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলে এ সমস্যা হতে পারে। অর্থাৎ কেবল নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে নয়, বরং সাফল্যসূচক পরিবর্তন ঘটলেও মানিয়ে চলার সমস্যা হতে পারে। যেকোনো রোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের মধ্যেও এ সমস্যা হতে পারে। শিশু-কিশোর, বয়স্ক-সবারই এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের এ সমস্যা বেশি হয়ে থাকে এবং বয়ঃসন্ধিকালে এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়। সাধারণত পরিবর্তিত পরিস্থিতি শুরু হওয়ার তিন মাসের মধ্যে এ সমস্যা তৈরি হয় আবার পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে এ সমস্যা দূর হয়ে যায়। মানিয়ে নেওয়ার এ সমস্যা বেশ কয়েক ধরনের হতে পারে। যেমন-বিষণ্নতাযুক্ত, উৎকণ্ঠাযুক্ত, বিষণ্নতা ও উৎকণ্ঠা দুই-ই যুক্ত, আচরণের সমস্যাযুক্ত, আচরণ ও আবেগের সমস্যাযুক্ত ইত্যাদি।
মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, এমন এক বা একাধিক কারণ থেকে মানিয়ে চলার সমস্যা হয়ে থাকে। একই কারণ বিভিন্ন বয়স ও ব্যক্তিত্বভেদে আলাদা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যেমন- ৪০ বছর বয়সী একজন স্বাবলম্বী মানুষ যদি দুর্ঘটনায় তাঁর মা-বাবাকে হারান, তবে তাঁর মধ্যে যে মানসিক প্রতিক্রিয়া হবে, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি প্রতিক্রিয়া হবে ১৫ বছর বয়সী একটি ছেলে যদি একসঙ্গে তার মা-বাবাকে হারায়। একটি কারণ থেকে মানিয়ে চলার সমস্যা হতে পারে আবার একটির ফলে সমস্যার কারণ ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে মানিয়ে চলার সমস্যা তীব্রতর হতে পারে। যেমন-প্রথমে ব্যবসায় ভরাডুবি হওয়া। এরপর ঋণের দায়ে ঘরবাড়ি নিলামে ওঠা। তারপর মামলার কারণে জেলে যাওয়া। জেলে থাকতে থাকতে কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং জেল থেকে শোনা যে তার তরুণ ছেলেটি মাদকাসক্ত হয়ে গেছে। এভাবে একটির পর একটি মানসিক চাপ সামাল দিতে না পেরে মানিয়ে চলার সমস্যা হয়ে যেতে পারে। আবার কখনো একসঙ্গে অনেকের মধ্যে এ সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন-কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা হঠাৎ করে কোনো একটি গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্রোহ-নির্মমতা শুরু হলে সেই দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট মানসিক ধকল সামলাতে না পারলেও মানিয়ে চলার সমস্যা হতে পারে। ব্যক্তিত্বের ধরন, বংশগতিধারা, মনঃসামাজিক গঠনের তারতম্য, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষমতা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে কখন কার কীভাবে মানিয়ে চলার সমস্যা হবে। এ সমস্যা যদি ছয় মাসের কম সময় থাকে, তবে তা স্বল্পমেয়াদি আর যদি এর চেয়ে বেশি সময় ধরে থাকে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে।
ব্যক্তিত্ব ও কারণের ধরন এবং মানিয়ে চলার সমস্যার প্রকারভেদে নানা রকম লক্ষণ দেখা যায়। তবে সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে মন খারাপ-বিষণ্ন থাকা, নৈরাশ্যে ভোগা, কান্নাকাটি করা, উৎকণ্ঠিত হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, হঠাৎ করে বিনা কারণে বা সামান্য কারণে রেগে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, খিদে কমে যাওয়া, নার্ভাস হয়ে যাওয়া, অপরের সঙ্গে যথাযথ আচরণ না করা, বড়দের সম্মান না করা, মারামারি করা, ধ্বংসাত্মক প্রবণতার উদ্রেক হওয়া, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা ইত্যাদি। এ ছাড়া ঘুমের সমস্যা, মাথাব্যথা, সব সময় নিরানন্দ থাকা, আত্মীয়-বন্ধুদের এড়িয়ে চলা, সামাজিকতা পরিহার করা, স্কুল-কলেজ বা অফিসে গরহাজির থাকা, মাদকাসক্ত হয়ে যাওয়া এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা বা চেষ্টা থাকতে পারে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে। একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে এ সমস্যার সঙ্গে বিষণ্নতার বেশ কিছু লক্ষণের মিল রয়েছে। এ ছাড়া উৎকণ্ঠা, মাদকাসক্তি, আচরণের বৈকল্য অথবা সাময়িক মনোবিকারের সঙ্গেও মানিয়ে চলার সমস্যার কিছু লক্ষণের মিল পাওয়া যায়। তাই এ ধরনের লক্ষণ থাকলে বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
মানিয়ে চলুন সবার সঙ্গে
যথাযথ চিকিৎসায় এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। সম্পূর্ণ চিকিৎসার জন্য সাধারণত তিন মাস সময় লাগতে পারে। মানিয়ে চলার সমস্যার সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি হচ্ছে সাইকোথেরাপি। স্বতন্ত্র ও গ্রুপভিত্তিক দুভাবে সাইকোথেরাপি দেওয়া যেতে পরে। প্রয়োজনে কাপ্ল থেরাপি বা ফ্যামিলি থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী কোনো প্রণোদনা শনাক্ত এবং ব্যক্তি কীভাবে সে প্রণোদনাকে মোকাবিলা করে, সেই দক্ষতা তাকে আয়ত্ত করতে শেখানো হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপিস্ট গাইড করেন মাত্র। ব্যক্তির নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ ছাড়া ক্রাইসিস ইন্টারভেনশন পদ্ধতিতে দ্রুততর সময়ে তাদের মানিয়ে চলতে সাহায্য করা হয়। মানিয়ে চলা সমস্যা চিকিৎসায় ওষুধের ভূমিকা তেমন না থাকলেও লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসায় অল্প দিনের জন্য অ্যাংজিওলাইটিক বা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও দৃষ্টিভঙ্গি বদল করে মানিয়ে চলা যায়। নিজের অনুভূতিটা বন্ধু বা স্বজনের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে, অপরের প্রতি হতে হবে সাহায্যশীল। পাশাপাশি অপরের সাহায্যও খোলামনে গ্রহণ করতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকদের সাহায্য নিতে হবে। শিশুদের যদি ছোটবেলা থেকেই নির্ভরশীল করে গড়ে না তুলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রপ্ত করানো হয়, তবে তাদের মানিয়ে চলার সমস্যা মোকাবিলা করার দক্ষতা অর্জিত হবে। সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুম, হালকা ব্যায়াম, নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ, সব সময় হাসি-খুশি থাকার চেষ্টা করা, কোনো ধরনের শখের চর্চা করা, পারস্পরিক সহায়তামূলক ও বিশ্বস্ত বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়ক হয় ও মানিয়ে চলার সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, মানিয়ে চলার দক্ষতা এক ধরনের ইতিবাচক গুণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি মানবিক শিল্প। তাই সব পরিস্থিতিতেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তৈরি থাকুন। নিজেই সিদ্ধান্ত নিন পরিবেশ বা ঘটনাপ্রবাহ আপনাকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করবে, আর আপনি কত নিপুণতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করতে পারবেন।
আহমেদ হেলাল
বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
(প্রেষণে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা)
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৩, ২০০৯