এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের দেশে ঈদের সঙ্গে ভ্রমণ এবং খাবারের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ঈদে অনেকেই বাড়ি ফিরেন। বলা যায় ঈদের সঙ্গে ভ্রমণ এক অবিচ্ছেদ্য বিষয়। একইভাবে ঈদ উৎসব মানে খাবারের সম্ভার। সুতরাং ভ্রমণ এবং খাবারে অসুস্থ হওয়াটা যেমন কাম্য নয় তেমনি ঈদের ভূরিভোজ যেন শেষে পুরো ঈদটাকেই মাটি করে না দেয় সে বিষয়েও একটু সতর্ক হতে হবে। যদিও ভোজন রসিক, ভোজন বিলাসী কিংবা পেটুক- এ ধরনের বদনাম ঝেড়ে ফেলে এখন অনেকেই খাবার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন হতে চাইছেন তারপরও ঈদের সময় এই একদিন একটু খেলে কিছু হবে না- অনুরোধের এমন বাক্যের ফাঁদে পড়ে কেউ কেউ যে সমস্যায় পড়ছেন না তা কিন্তু নয়।
ভ্রমণের খুঁটিনাটি
ঈদ ভ্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়াটা মোটেও কাম্য নয়। তারপরও অনেকেই কিন্তু ভ্রমণের কারণে ঈদের আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েন কিংবা ঈদের দিনটিতে থাকেন অসুখে আক্রান্ত। বিশেষ করে শিশুরা খুব সহজেই জ্বর বমি সর্দি কাশি ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে এ সময়ে। এই অসুস্থতার অন্যতম কারণ কিন্তু অসচেতনতা। ভ্রমণে অভিভাবক যদি শিশুদের ব্যাপারে একটু সচেতন থাকেন, তাদের দিকে যদি আরও একটু বেশি খেয়াল রাখেন তা হলে এ সব সমস্যা থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া সম্ভব। বিষয়টি খুবই সিম্পল। যেমন ধরুন ট্রেনে, বাসে কিংবা লঞ্চে ভ্রমণের সময়ে শিশুরা সব সময়েই জানালার ধারের সিটটি পছন্দ করে থাকে। এ কারণে হঠাৎ করেই শিশুরা অতিরিক্ত বাতাসের ঝাপটার মুখোমুখি হয় যা অনেকেরই হয়ত সহ্য ক্ষমতার বাইরে। এর ফলে ভ্রমণের পর অনেক শিশুই আক্রান্ত হয়ে পড়ে সর্দি কাশি কিংবা জ্বরের সাধারণ অথচ বিরক্তিকর সমস্যায়। এসব ক্ষেত্রে অভিভাবকরা চাইলে শিশুর ভ্রমণের আনন্দকে নষ্ট না করে বিষয়টিকে ম্যানেজ করতে পারেন। ভ্রমণে শিশুরা আরেকটি সমস্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় তা হচ্ছে ডায়রিয়া। যেহেতু এই সমস্যাটি খাবার এবং পানিবাহিত তাই এই দুটি বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকাটা খুবই জরুরি। জরুরি এ কারণে যে এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হলে এর উপসর্গ দেখা দিতে খুব একটা সময় নেয় না। অনেক সময় ভ্রমণকালীনই বমি কিংবা ডায়রিয়া শুরু হয়ে যেতে পারে। ভ্রমণে নিজের কিংবা আত্মীয়-পরিজনের এ ধরনের অসুস্থতা কতটা বিপদগ্রস্ত করতে পারে তা খুব সহজেই অনুমেয়। এ কারণে ভ্রমণে কখনই বাইরের খাবার খাওয়া উচিত নয়। ভ্রমণে বাড়ির তৈরি খাবার সঙ্গে নিয়ে বের হওয়াটাই উত্তম। শিশুরা যাতে যাত্রাপথে এটাসেটা খেতে না চায় সে বিষয়ে আগে থেকেই তাদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। তবে এই প্রস্তুতি হঠাৎ করে সম্ভব নয়। অভিভাবকদের বিভিন্ন সময়ে শিশুকে আচরণগত নানান শিক্ষা দেয়ার সময়েই এ বিষয়গুলো উপদেশ হিসেবে দেয়া উচিত। তা ছাড়া ভ্রমণের সময় দুর্ঘটনা এড়ানোর যাবতীয় বিষয় ভ্রমণে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তির নখদর্পনে থাকা উচিত। যেমন ধারা যাক, বাসে, ট্রেনে জানালার বাইরে যাতে কেউ অসর্তকভাবে মাথা বের না করে, লঞ্চের বারান্দায় কিংবা ফেরিতে কোনো শিশু যেন দায়িত্বশীল কারও তত্ত্বাবধান ছাড়া না দাঁড়ায় এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা জরুরি। দুর্ঘটনার সম্ভাব্য এই সব কারণগুলো সম্পর্কে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি যদি টাইম টু টাইম প্রাপ্তবয়স্ক অন্যদেরও সতর্ক করেন তা হলে সবাই মিলে সহজেই একটি নিরাপদ ভ্রমণের মাধ্যমে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব।
ঈদ ভ্রমণে সঙ্গী ওষুধ
যারা রোগী তারা ঈদ ভ্রমণে সঙ্গে করে ওষুধ নিয়ে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রোগী না হয়ে ভ্রমণে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র আপনার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া উচিত সাধারণ কিছু রোগের জন্য। যেমন- পেটের গন্ডগোল, পেটে গ্যাস, বদহজম, সাধারণ সর্দি-কাশি, বমি, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, মাসিকের ব্যথা ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ সঙ্গে রাখতে পারেন। এ সব ওষুধ সঙ্গে রাখার আরেকটি কারণ হলো, প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব ওষুধ অধিকাংশ সময়েই পাওয়া যায় না। কাজেই ভ্রমণের আগে যেসব ওষুধ সঙ্গে নেয়া যেতে পারেন সেগুলো হচ্ছে- জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথার জন্য প্যারাসিটাল (ডোজ : ১টা করে দৈনিক ৩ বার)/ পেটের পীড়ার জন্য মেট্রোনিডাজল ৪০০ মি.গ্রা, (ডোজ : ১টা করে দৈনিক ৩ বার)/ সিপ্রোফ্লক্সাসিন (ডোজ : ১টা করে দৈনিক ২ বার), পেটে গ্যাস, পেট ফাঁপা, বুক জ্বালার জন্য এন্টাসিড (ডোজ : ১টা করে দৈনিক ৩/৪ বার), পেপটিক আলসারজনিত সমস্যার জন্য রেনিটিডিন (ডোজ : ১টা করে দৈনিক ২ বার), ডায়রিয়ার জন্য খাবার স্যালাইন, কাশির জন্য যেকোনো একটি কফ সিরাপ। এইসব ওষুধ সঙ্গী হলে সাধারণ অসুখ বিসুখ আপনার ভ্রমণে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না।
ঈদে গর্ভবতীর স্যাক্রিফাইস
এমন অনেক গর্ভবর্তী আছেন এবারের ঈদে যাদের ভ্রমণ করা ঠিক হবে না। গর্ভবস্থায় ৭ মাস পর্যন্ত দূরের কোনো ভ্রমণে না যাওয়াই ভাল। এতে গর্ভপাতসহ নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে, যা গর্ভবর্তীর জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই বিবেচনায় অনেক গর্ভবতীই হয়ত আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে ঈদ উৎসব অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কাজেই গর্ভবতী ও গর্ভস্থ শিশুর সুস্থতার কথা বিবেচনা করে এবারের ঈদের আনন্দ কিছুটা স্যাক্রিফাইস করতে হবে।
ডা. সজল আশফাক
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নাক-কান-গলা বিভাগ, হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চেম্বার : ইনসাফ ডায়গনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার, ১২৯ নিউ ইস্কাটন, ঢাকা। মোবাইল : ০১৫৫২৩০৮৬২৩।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০০৯