বলা যেত নিরাপদ খাবার স্বাস্থ্যের জন্য। কিন্তু শিরোনামটি বদলে ফেললাম। খাবার নিরাপদ না হলে বেঁচে থাকাই তো দায়, স্বাস্থ্য তো দূরের কথা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যে খাবার তৈরি হচ্ছে এবং বিক্রি হচ্ছে তা-ই নয়, নানা কৃত্রিম উপায়ে কেবল দুষ্ট ব্যবসায়িক স্বার্থের জন্য খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষের প্রাণ হরণের যে প্রচেষ্টা কেউ কেউ করেন, এতে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। খাদ্যে ভেজাল শাস্তিযোগ্য অপরাধ, আর কোনো কোনো দেশে শিশুখাদ্যে ভেজাল মৃত্যুদণ্ডতুল্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করার মধ্যে যুক্তি আছে বলে মনে হয়। আমাদের সমাজে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এত দুর্বল, কঠোর আইন প্রয়োগ এত দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের দোলাচলে আবর্তিত এবং ধারাবাহিকতা এত দিনের যে একে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা দুঃসাধ্য কাজ মনে হচ্ছে। আসলে মূল্যবোধ না থাকলে সমাজের বুননটি বড়ই আলগা হয়ে যায়, আর এ জন্য সামান্য নৈতিকতা-বিবর্জিত হয়ে মানুষের জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি করে নিজের পকেট ভর্তি করার এ উদ্যম ও উদ্যোগ এ অবক্ষয়েরই প্রকাশ মাত্র।
ইদানীং শোনা যাচ্ছে, মুখরোচক চিপসের মধ্যে মেশানো হচ্ছে কৃত্রিম রং। শিশু-কিশোর এমনকি বয়সী লোকও অবসরে চিপস চিবোতে পছন্দ করেন। চিনাবাদাম ও ভাজা ছোলা আজকাল কম লোকেই খান, চিপসই এখন বেশির ভাগ মানুষের প্রিয় খাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্যই কি দুষ্ট ব্যবসায়ীরা চিপসই বেছে নিলেন জীবন হরণের উপযোগী করে তোলার জন্য? কিছু দুষ্টলোক যে ব্যবসায়ী সমাজকে বিব্রত করলেন, এ জন্য তাঁদের লজ্জা হয় বলে মনে হয় না। শোনা যায়, ছোট ছোট কারখানায় এসব ভেজাল চিপস তৈরি হয়ে বাজারে আসছে, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের কারখানায় তৈরি হওয়া চিপসের পাশাপাশি।
এই চিপসগুলো দামে সস্তা। তবে এগুলো বিক্রি হয় পথের ছোটখাটো দোকানে, ফেরি করেও এগুলো বিক্রি হয়। ছোট কারখানায় তৈরি চিপসে মেশানো হয় কৃত্রিম রং, আর সে কাজটিও যে করা হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, তা বলাই বাহুল্য। এখানেই শেষ নয়। অনেক খাবার ও পানীয়তে কম-বেশি রং মেশানো হয়—এমন খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। মাছ, সবজি ও ফলেও ভেজাল। ফলের ভেতর ইনজেকশনের সুঁই ফুটিয়ে তরল ইনজেক্ট করার মতো ভয়ানক ব্যাপার ঘটছে। কলা, পেঁপে, তরমুজ, আম, যখন যে মৌসুমি ফল বাজারে আসছে এর মধ্যে কৃত্রিম রং ঢোকানো, ভেজাল খাদ্যে রূপান্তরিত করার এই দুষ্কর্ম চলছেই। পুষ্টিজ্ঞান জনগণকে দিয়ে লাভ কি, যে খাবারে পুষ্টি, সে খাবারটি ভেজাল হলে পুষ্টি হবে কী করে? সফট ড্রিংকস বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে বেশ প্রিয়, আর তাই এই কোমল পানীয় যাতে কোমলমতি তরুণদের স্বাস্থ্যের ভয়ানক ক্ষতি করতে পারে এ জন্য দুষ্টলোকেরা বেশ সক্রিয়। এসব খাবারে যে রং মেশানো হচ্ছে, তা নাকি টেক্সটাইল রং ও লেদার কালার। খাদ্য মনোলোভা হলেও বিষাক্ত, সর্বনাশা তো বটেই, এমনই খবর। সে সঙ্গে এখন নতুন যোগ হয়েছে এনার্জি ড্রিংকস। হতোদ্যম তরুণদের শরীর ও মনে অফুরন্ত শক্তি জোগানোর অভিনব উদ্যোগ। দেহের প্রধান প্রধান যন্ত্র, কিডনি, হূিপণ্ড, মগজ, পেশি, পরিপাকতন্ত্র—এসব যে বিকল হতে চলেছে ভেজাল খাদ্যের জন্য, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
কাচকি মাছ খাবেন, এতেও ফরমালিন মিশিয়ে চকচকে করে তোলা হচ্ছে এবং তা বিক্রিও হচ্ছে। মাছকে তাজা দেখানোর কী ভয়ংকর আয়োজন। জেনেশুনে বিষ গ্রহণ কেন করব আমরা। তাই ভয় পেলে চলবে না। আমাদের এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ভেজাল নিয়ন্ত্রণকারী, মান নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কঠোর হলে আর আইনি প্রয়োগ কঠোর হলে এসব সমস্যা দূর হবে অবশ্যই। সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভোক্তাসাধারণের সচেতনতা। তারা সচেতন হলে, এই অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে আমরা একে অতিক্রম করতে পারব। বিশ্বাস করি, সরকার আন্তরিক এবং তারা এই ভেজাল খাদ্য ব্যবসায়ীদের দমন করে, নিরাপদ খাদ্য সবরাহের ব্যবস্থা করে জনগণের ধন্যবাদ ও প্রশংসার পাত্র হবে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
নিরাপদ খাবার বেঁচে থাকার জন্য পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ৩০, ২০০৯