ত্বক নিয়ে, শরীরের এই বৃহত্তম অঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে অনেক। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও এ নিয়ে কম ভাবেননি।
ভেবেছেন জাদুঘরের কর্মকর্তারাও। লন্ডনে ওয়েলকাম ট্রাস্টের প্রদর্শনীতে ত্বকের সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক, গোত্রীয় ও সংবেদনগত দিক উপস্থাপিত হলো। আশির দশকে যখন লন্ডনে ছিলাম গবেষণার জন্য, তখন অনেক সপ্তাহান্তে ছুটিতে গেছি ওয়েলকাম মিউজিয়ামে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসের নানা অধ্যায় ও ধাপ নানা নমুনা ও নিদর্শনের মাধ্যমে সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে, সেই সব প্রদর্শনী দর্শকনন্দিতও হয়েছে। ব্রিটেনের ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম ও ওয়েলকাম ট্রাস্টের প্রদর্শনী সত্যিই দর্শনযোগ্য। সেই প্রদর্শনীতে খুব সুন্দর, কোমল ও দৃষ্টিনন্দন শারীরস্থানের চিত্রকর্মের পাশাপাশি রয়েছে রুগ্ণ ত্বকের ভয়ানক চিত্র, ত্বকের নানা রকমের উলকির চিত্র এসব। সংগ্রহটি সত্যি কৌতূহলোদ্দীপক, আর এটি দেখে দর্শকেরা ত্বক নানা দিক থেকে চিন্তার মধ্যে, ভাবনার মধ্যে নিতে পারেন। প্রদর্শনীর চারটি মূল থিম হলো: বস্তু, চিহ্ন বা নিদর্শন, ছাপ এবং মরণোত্তর চিহ্ন ও দৃশ্যপট। ত্বকের ইতিহাসের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া যায়, অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ত্বক দেহের একটি অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি, দেহের আন্তরযন্ত্রের আবরণ হিসেবেই একে দেখেছেন সবাই, তবে সে সময়কার শারীরস্থানবিদের কৌতূহলও এ সম্বন্ধে উদ্দীপিত হয়েছে, নিঃসন্দেহে।
এ মতবাদটি রেনেসাঁর সময়কার অনেক চিত্রকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে, চিত্রকর্মে প্রাণীদের গাত্র চর্মশূন্য করে দেখানো হয়েছে। ত্বকের রোগ নিয়ে প্রথম লিখিত নথির প্রমাণ পাওয়া যায় অষ্টাদশ শতকের দিকে, তবে ত্বকবিজ্ঞান বা ডার্মাটোলজির গোড়াপত্তন হয় ঊনবিংশ শতকের দিকে। সেই যুগ থেকে ত্বকের রোগের শৈল্পিক নিদর্শনগুলো অদ্ভুত নিখুঁত ও আকর্ষণীয়, ত্বকের বিকৃত রুগ্ণ রূপ তো প্রদর্শিত হয়েছেই। মোমের কাজের শিক্ষা মডেলগুলো চমৎকার উপকারে এসেছে।
বিশ শতকের শিক্ষামূলক ভিডিও, গ্রাফিক শিল্পকর্ম, শারীরস্থান মডেলগুলো ত্বক সম্বন্ধে অনেক কিছু জানার সুযোগ করে দেয়। ত্বকের বৈজ্ঞানিক দিকই কেবল নয়, প্রদর্শনীতে ত্বকের সঙ্গে সত্তা বা নিজ পরিচয়ের যে সম্পর্ক তাও দেখা যায়। ক্ষতচিহ্ন, নিদর্শন, ছাপ, উলকি—সবই নিজস্ব পরিচয়পত্রের মতো। টানসিন ভ্যান এসেন নামে চিত্রশিল্পী সিরামিক কিছু জার উপস্থাপন করেছেন, প্রতিটিতে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ত্বকরোগের নিদর্শন। হয়তো এসব সিরামিক ওষুধপাত্র তৈরি একই রকম, কিন্তু এদের বহির্গাত্রে রয়েছে ত্বকের নানা রোগের বিভিন্ন চিত্র, নিখুঁত শিল্পের ছায়ায় নির্মিত। ত্বকচিহ্ন বা উলকি সাংস্কৃতিক নিদর্শনও বটে। নিউজিল্যান্ডের মাওরি জনগোষ্ঠীর মুখমণ্ডলে আঁকা এসব উলকি কৌতূহল জাগায় দর্শকের মনে।
দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েদিদের একজনের গায়ে আঁকা উলকি কী করে ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে যায়, এর একটি আলোকচিত্রও রয়েছে। এদের উলকির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে সে কী ছিল, কী হয়েছে—এসব।
এ প্রদর্শনীতে রয়েছে ফ্যাশন ও স্ট্যাটাস নির্ণয়ে ত্বকের অবদান। ত্বকের বহিরঙ্গের একটি চিত্র বাদামি ত্বকের মধ্যে। দৈহিক শ্রমের কারণে রৌদ্রালোক স্পর্শ করত শরীর, ত্বক হতো বাদামি, এ জন্য অভিজাত ভিক্টোরিয়ানরা হতেন কায়িকশ্রমবিমুখ, নিজের ঠাঁটবাট বজায় রাখার জন্য।
৯৩০ সালে ত্বক বাদামি হয়ে উঠল ভ্রমণ ও সম্পদ আহরণের চিহ্ন। বার্ধক্যের, জরার যে চিহ্ন পড়ে ত্বকে, স্পষ্ট সেসব চিহ্নকে ঢাকার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা মানুষের। কত ওষুধ, প্রসাধনী ব্যবহার করে আসছে মানুষ! ইদানীং ত্বক সংরক্ষণ একটি রমরমা ব্যবসা, যৌবন ধরে রাখার জন্য মানুষের অন্তহীন ইচ্ছা ও প্রচেষ্টার তাগিদেই প্লাস্টিক সার্জারি ও প্রসাধনী শিল্পের দিন দিন উন্নতি ঘটছে। রয়েছে স্কিনল্যাব।
রয়েছে মার্টা লাইনের উপঝিল্লিকোষের গহনা, রয়েছে রিয়ান সলোমনের পুনর্গঠিত ত্বকের মডেল। ‘স্কিনব্যাগ’ পোশাক রয়েছে অলিভার গলেটের ডিজাইন করা। সুস্থ ত্বকের মতোই সিনথেটিক এসব পোশাক দৃষ্টি কাড়ে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাইরেও ত্বককে নিয়ে যেন ভাবা যায়। এর সাংস্কৃতিক, নান্দনিক দিকগুলোও ঠাঁই পেয়েছে প্রদর্শনীতে।
একটি সৎ অঙ্গ হিসেবে এর অবস্থান, বয়সের চিহ্ন পড়ে ত্বকে, রোগের নিদর্শন ত্বকে, ত্বকে দেখা যায় কুঞ্চনরেখা, ঝুলে পড়া ও জরা চিহ্ন। মানুষের বয়স, সে তরুণ না বৃদ্ধ, বলা যায় ত্বক দেখেই। মূলত ত্বক যেন বলে দেয় একজন ব্যক্তির ইতিহাস।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল
সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৮, ২০১০