২৮ ফেব্রুয়ারি ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস।
ডায়াবেটিসকে শরীরের একটি রোগ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত আমরা। শরীরের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু যাদের ডায়াবেটিস হয়েছে তারা জানে এ রোগ জীবনের সর্বত্র প্রভাব ফেলে, আমাদের আবেগগত, আত্মিক ও মানসিক—সবকিছুতেই।
কেন নয়? যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের অনেকের হয় বিষণ্নতা, সাধারণ স্বাস্থ্যবান মানুষের চেয়ে বেশি তো বটেই। চিকিৎসককে যে সব সময় এর ব্যাখ্যা দিতে হবে, তা নয়।
ডায়াবেটিস বেশ জটিল রোগ, বেপরোয়া, অনেক সময় এর গতিবিধি বোঝাও কঠিন। এর চিকিৎসাও ব্যক্তিভেদে, অবস্থাভেদে ভিন্ন। সর্বসম্মত একটি চিকিৎসা পরিকল্পনা দেওয়া হলো, কিন্তু তা কাজ করল না, বদলাতে হলো অবস্থা ও গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী।
মোকাবিলা করার ব্যাপারটা চিকিৎসকের যেমন, তেমনি রোগীর দায়দায়িত্বও কম নয় মোটেও। চমৎকার চিকিৎসক ও তাঁর টিম, সহযোগিতা দেওয়ার মতো পরিবার ও উৎসাহ দেওয়ার মতো বন্ধু পেলেও রোগীর দায়িত্ব খুব কমে যায় না। ভিড়ের মধ্যে একলা মনে হওয়ার মতো অবস্থা হয় অনেক সময়।
চার বছর ধরে আমার ডায়াবেটিস, কিন্তু একে বেশ সামলে চলছি। একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রেখে চলতে পারছি, সুস্থ মানসিক অবস্থাও আমার। কীভাবে?
প্রথমে যখন আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়ল, তখন শোকে মুহ্যমান আমি। পাগল হওয়ার মতো অবস্থা। ছোট বাচ্চার মতো হাত-পা ছোড়াছুড়ি। অনেক কেঁদেছি আমি। ঈশ্বরকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছি: হা ঈশ্বর, কেন আমি? পুরো জগতের ওপর ভীষণ রাগ হলো আমার।
চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র, নির্দেশিকা বই, পুস্তিকা—এসবের মধ্যে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ।
প্রিয়জন বিয়োগ হলে যা হয়, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা বলেন, ঠিক আছে, সামলে নাও একে, এগিয়ে যাও। ডায়াবেটিস হওয়ার পর চিকিৎসক, স্বজন সবাই তো তেমন সান্ত্বনাবাক্য শোনালেন। তবে সত্য কথাটি হলো, কখনো কখনো জীবনকে বদলে দেওয়ার মতো রোগ নির্ণয় হলে, কেবল জোর করে একে সামলানো যায় না। এর জন্য সময় লাগে। সচল সুন্দর শরীরে গোলযোগ যা হলো, লোভনীর সব খাবার খাওয়ার ইতি ঘটল—এই হারানোর বেদনাকে সইয়ে নিতে সময় লাগে। এই মন খারাপ হওয়াকে সামলে উঠতে হয়। এ জন্য আমার প্রয়োজন ছিল চিকিৎসকের পরামর্শ। আর চমৎকার সেই চিকিৎসক, একে মোকাবিলা করার জন্য এত সাহায্য করেছিলেন, কী বলব!
একসময় বুঝলাম, মনে দুঃখ পুষে রেখে কী লাভ? এতে আমার কি ভালো হবে? ভালো হবে কি স্বাস্থ্যের? আমাকে লড়াই করতেই হবে। জিততেও হবে।
চিকিৎসক বলেছিলেন আমার টাইপ ১ ডায়াবেটিস। চিকিৎসা ইনসুলিন ইনজেকশন। ইনসুলিন না নিলে তো মরেই যাব।
আর তা করতে হবে মনপ্রাণ দিয়ে। একটু কম করলাম, অন্যদিন বেশি করলাম, তা নয়। এভাবে চিকিৎসা ঠিকমতো না করলে হূদরোগ বা কিডনির রোগে ধীরগতিতে অন্তিম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাব কেন?
কাজেই নামলাম মনপ্রাণ দিয়ে।
নিজেকে রোগ সম্বন্ধে সচেতন করা, এ সম্বন্ধে সবকিছু জানতে উদ্যোগী হলাম। অনলাইনে ডায়াবেটিস ফোরামে যোগ দিলাম। ডায়াবেটিস নিয়ে বই-পুস্তিকা পড়তে থাকলাম। পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ পড়লাম।
গেলাম বারডেমে। সেখানে ডায়াবেটিস ও পুষ্টিশিক্ষা—দুই ব্যাপারেই রোগীদের ক্লাস নেওয়া হয়। ওখানে নিজের নাম রেজিস্ট্রি করে যোগ দিলাম ক্লাসে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনেকগুলোও, চোখ পরীক্ষা-পা পরীক্ষা, বিনে পয়সায় হয় সেই প্রতিষ্ঠানে।
ইনসুলিন ইনজেকশনও অনেককে দেওয়া হয় বিনে পয়সায়। আমার চিকিৎসা যাঁরা দিচ্ছিলেন তাঁদের সঙ্গে মিলে একত্রে বেশ একটি কৌশল বের করলাম রোগকে মোকাবিলা করার। ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনা আমার প্রতিদিনের কাজের রুটিনের অংশ হয়ে গেল। রোগটিকে নিজের রোগ হিসেবে গ্রহণ করলাম, তখন কেন জানি নিজের মধ্যে একে রোখার জন্য ক্ষমতায়ন ঘটল আমার। এ নিয়ে যত জানলাম, যত কথা বললাম, তত বেশি একে লড়ার সাহস পেলাম। আমি রোগী—এমন ভাব অনেক কমে গেল।
তৃতীয়ত, আমি আরও অনেক লোকের কাছে পৌঁছে গেলাম। ডায়াবেটিস হয়েছে এমন অনেকের সঙ্গে পরিচিত হলাম বারডেমে রোগীদের জন্য নির্ধারিত ক্লাস করার সময়। তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। অনলাইন ব্লগেও অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। শেয়ার করলাম অনেক কিছু। আমি দেখলাম নিজেকে একলা রেখে আমার শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হয় না। অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে আমিও অনেক কিছু জানলাম, আবার আমার অভিজ্ঞতাও শেয়ার করলাম।
আমি যা যা করে সুফল পেয়েছি তা অন্যদের করতে বলার জন্য উৎসাহিত করে বেশ আনন্দ পেলাম, কেমন জয়ী জয়ী অবস্থা না?
আমরা বলি, ‘দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’। এ কাজে লোকবল যত বাড়ে, বন্ধু যত বাড়ে তত বেশি সুফল পাই আমরা।
সাপোর্ট, উৎসাহ দান, প্রশ্নোত্তর, আলাপ—এসব করার জন্য নিজেকে যখন খুলে দিলাম, তখন বুঝলাম, আমি আর একা নই।
আমার নতুন করে ক্ষমতায়ন ঘটল।
অন্য আরেকজন যখন আমার এই লড়াই ও অর্জনকে বুঝতে পারছে, এমন বোধ নিজের মধ্যে হলো, আমি মনে তাই আরও জোর পেলাম, নতুন তাগিদ মনে এল এ ব্যাপারে অন্যের সঙ্গে আলাপ করার জন্য, প্রয়োজনে ধারণা ও প্রয়োগ কৌশল পরিবর্তনের জন্য এবং নতুন করে অনেক কিছু শেখার জন্য।
শেষে আমি বুঝলাম, ডায়াবেটিস জীবনভর রোগ। তবে একে মোকাবিলা করে জীবন পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায়। ডায়াবেটিসের জন্য প্রয়োজন দৈহিক, মানসিক, আবেগগত ও আত্মিক স্বাস্থ্যের একটি ভারসাম্য রক্ষা করে চলা। মানসিকভাবে সুস্থ না হলেও তা প্রতিফলিত হবে রক্তের সুগার মানে। তাই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যা করা দরকার, তা হলো রক্তের সুগারকে স্বাস্থ্যকর মানে বজায় রাখা। চেয়ারের তিনটি পা মজবুত রাখলাম, কিন্তু অন্য পায়ের দিকে নজর করলাম না, অবহেলা করলাম, তখন পুরো কাঠামো ভেঙে পড়বে।
তাই কেবল শরীরের স্বাস্থ্য নয়, গোটা স্বাস্থ্যের দেখভাল করা, একে উত্তম মানে রাখা হলো বড় কাজ।
বারডেমে ঢুকি, ঢোকার পথে মহান মানুষ অধ্যাপক ইব্রাহিমের ছবি। মনে বল পাই, নিজেকে মোকাবিলার।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১১