একটি দোতলা ভবন। অত্যন্ত পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে আটটি বিছানা, বিনোদনের জন্য রঙিন টেলিভিশন এবং ছোট একটি পার্কের মতো-যেখানে শিশুদের জন্য বেশ কিছু খেলনাও রয়েছে। রুমের মধ্যে রয়েছে আধুনিক শৌচাগারের ব্যবস্থা। এখান থেকে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সব ধরনের আইনি সহায়তা দিচ্ছে। রাজধানীর তেজগাঁও থানা চত্বরে অবস্থিত এ আশ্রয়কেন্দ্রটিই হচ্ছে ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার’। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের আশ্রয় বা থাকার জন্য পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির সহায়তায় পুলিশ এ ব্যবস্থা চালু করেছে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এর আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করেন।
মূলত পুলিশ রিফর্মস প্রজেক্টের আওতায় এ কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছে। আর এর অর্থায়ন করেছে ইউএনডিপি, ডিএফআইডি, ইউরোপীয় কমিশন ও বাংলাদেশ সরকার। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পুলিশের পাশাপাশি ১০টি এনজিও আইনি সহায়তাসহ অন্যান্য কাজ করছে। এগুলো হচ্ছেঃ আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, অ্যাসোসিয়েশন ফর কারেকশন অ্যান্ড সোশ্যাল রেক্লেমেশন, অপরাজেয় বাংলাদেশ, এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), ঢাকা আহছানিয়া মিশন ও মেরী স্টোপস্।
জানা গেছে, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের থাকার জন্য আটটি বেড রয়েছে, এখানে সর্বোচ্চ পাঁচ দিন পর্যন্ত থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এর পরও যদি কোনো ভিকটিমকে থাকতে হয়, তাহলে তাকে সংশ্লিষ্ট কোনো এনজিওতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি যত দিন প্রয়োজন তত দিন থাকতে পারবেন। এ সেন্টারে ১০টি এনজিও রুটিন অনুযায়ী কাজ করে। যেমন-শনিবারে অপরাজেয় বাংলাদেশ, রোববারে জাতীয় মহিলা পরিষদ, বুধবারে ব্লাস্ট এবং বৃহস্পতিবারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবীরা এখানে কাজ করেন।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের মুখ্য উদ্দেশ্য হলোঃ ১· সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা দূর করে নারী ও শিশুর প্রতি সংঘটিত অপরাধ প্রতিবেদনের সুযোগ নিশ্চিত করা। ২· ভিকটিমকে সময়োপযোগী ও পেশাগত সেবা প্রদান করা। ৩· ভিকটিমের সুরক্ষা ও আইনগত অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করা। ৪· সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ভিকটিমের সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করা। ৫· ভিকটিমকে বারবার নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা। ৬· নারী ও শিশুর প্রতি সংঘটিত অপরাধের তথ্য সংরক্ষণ করা এবং অপরাধ নিবারণের জন্য কার্যকর নীতি তৈরি করা।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে অভিযোগ করে প্রতিকার পেয়েছেন ঢাকার আগারগাঁও (তালতলার) এক গৃহবধূ। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী যৌতুকের জন্য আমাকে নির্যাতন করতেন। একপর্যায়ে আমার বাচ্চাকে রেখে দেন। এই অবস্থায় আমি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে অভিযোগ করলে তারা আমার বাচ্চাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়। আমাদের ভাঙা সংসারও এখন জোড়া লেগেছে।’ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) শামীমা পারভিন বলেন, ‘নির্যাতিত নারী ও শিশুদের জন্য এ কেন্দ্রটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এখানে মোট ২১ জন মহিলা পুলিশ কাজ করছেন। এর মধ্যে সহকারী কমিশনার থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত রয়েছে। তা ছাড়া প্রতিটি এনজিওর পক্ষ থেকে প্রতিদিন একজন করে আইনজীবী আসেন। চিকিৎসক ও কাউন্সিলরও উপস্থিত থাকেন। সব মিলিয়ে আমরা টিমওয়ার্কের মতো কাজ করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যখন আমাদের কাছে কোনো ভিকটিম অভিযোগ নিয়ে আসে, তখন তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে খাতায় তার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করি। এরপর ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা যাচাই করি। যাচাই শেষে দেখা হয় যে এটা আমলযোগ্য, না অ-আমলযোগ্য অপরাধ। এরপর আমরা সেভাবেই সামনে এগিয়ে যাই। আমরা ভিকটিমকে জানিয়ে দিই যে আপনার সামনে এই এই আইনগত পথ বা দিক রয়েছে। তখন ভিকটিমের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অধিকাংশ ভিকটিমই সংসার টিকিয়ে রাখতে মীমাংসার পথে যেতে চায়। তখন আমরা উভয় পক্ষকে ডেকে তাদের কথা মনোযোগসহকারে শুনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করি। এ সময় আইনজীবী, চিকিৎসক, কাউন্সিলর, ডিউটি অফিসার ও আমি উপস্থিত থাকি। পরবর্তী সময়ে আমরা এটাকে টিকিয়ে রাখতে ঘটনার ফলোআপও করছি। তবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ মারাত্মক ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থাও নিই।’
দুই মাসে এই সেন্টারে ৮৩ জন ভিকটিম এসেছে। এদের অধিকাংশ পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। এ সংক্রান্ত তিনটি মামলা মিরপুর, আদাবর ও কোতোয়ালি থানায় তদন্তাধীন। এ পর্যন্ত কোনো মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি। তবে এর মাঝেও গাড়ির ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটা পেলে তদন্ত কার্যক্রমসহ অন্যান্য কজের গতি বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টব্যক্তিরা জানান। আগামী জুন মাসে পিআরপির নতুন বাজেট হলে ছয়টি বিভাগীয় শহরেও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার চালু করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা যায় ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার চালু হওয়া নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। আসলে এটা শুধু পুলিশের একার কাজ নয়। এ ব্যাপারে অন্যান্য আইনগত ও মানবাধিকার সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। বিষয়টি নতুন হওয়ায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। মাত্র দুই মাসের ভিকটিম সেন্টারের কার্যক্রমকে মোটামুটি সন্তোষজনক বলা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া কঠিন, তাই অন্তত বিভাগীয় শহরগুলোয় এটা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।’
এ সম্পর্কে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক আশরাফুল হুদা বলেন, ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার খোলা একটি অত্যন্ত প্রশংসিত উদ্যোগ। এখন এটাকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে নিয়মিত তদারক করা প্রয়োজন। এ সেন্টারকে কাজের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি পুলিশ-ভীতি দূর করতে হবে।’
এ সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহিদুল হক বলেন, ‘মূলত ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার পুলিশ সংস্কার প্রকল্পের আওতায় করা হয়েছে। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। সম্ভব হলে এটাকে ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোয় ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। আমরা এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সুপারিশ পাঠাব।’
ফজলুল করিম
তথ্যসূত্র : prothom-alo.