শরীর ও মনের নানা রোগ প্রতিরোধে মনের শিথিলায়ন এবং ধ্যানচর্চার যে বড় ভূমিকা রয়েছে, তা ক্রমেই বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে।
বলা হচ্ছে, ট্রানসিডেনটাল মেডিটেশন বা তূরীয় ধ্যান বেশ ফলপ্রসূ। ৭০ বছর বয়সী একজন মহিলা ধ্যানচর্চা শুরু করলেন।
তাঁর ধমনিপথ অনেকটা রুদ্ধ, উচ্চরক্তচাপ এবং তলপেটে মেদ—এসব ঝুঁকি তাঁর ছিল। ভদ্র মহিলার ১০ বছর পেরিয়েছে, তিনি এখন দিনে দুবার ধ্যান করেন, প্রতিবার ২০ মিনিট। বড় রকমের একটি হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর যিনি বেঁচে উঠলেন, করোনারি বাইপাস সার্জারি ও দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার পর তিনি এখন শরীর ও মন শিথিলায়নে রত। তিনি বলেন, ‘মনে এখন অনেক কিছুর তোলপাড়, সবকিছু ভুলে ধ্যান করুন, নিজের জীবন হবে লাবণ্যময়।’ যে সমস্যা ছিল বলে মনে করেন, তা হয়তো থাকবে না। মনের শিথিলায়নের কোনো সুফল কি শরীরের ওপর পড়ে? সেই ভদ্র মহিলার ক্ষেত্রে সুফল পড়ে ছিল। তাঁর রক্তচাপ এসেছিল নিয়ন্ত্রণে, ওষুধ যদিও খান তবু নিয়ন্ত্রণে আছে এও কম নয়, তিনি ওজন কমিয়েছেন ৭৫ পাউন্ড।
আমেরিকার ওরল্যান্ডোতে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভায় নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসব গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছিল। বলা হচ্ছে: তূরীয় ধ্যান, অর্থাত্ চেতনার স্তর থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ উচ্চমার্গে থাকা—এতে বেশ লাভ হয়। এ ধরনের ধ্যান করার জন্য বড় প্রস্তুতি লাগে না, চেষ্টা করলে সম্ভব। নীরবে বসে চোখ বুজে একটি বিশেষ শব্দ বারবার মনে মনে উচ্চারণ করতে করতে গভীর ধ্যান করা এবং এভাবে মগ্ন হওয়া, শান্তির জগতে ভ্রমণ করাই তূরীয় ধ্যান। যাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি খুব বেশি এবং করোনারি হূদরোগ রয়েছে, তাদের জন্য এমন ধ্যানচর্চা বেশ ফলপ্রসূ।
ধ্যানচর্চা অবশ্য চিকিত্সা বা ওষুধের বিকল্প নয়, ওষুধের সঙ্গে একে যুক্ত করলে হিতকর ফলাফল অনেক বেড়ে যায়। ২০০ জন রোগীকে পাঁচ বছর অনুসরণ করে গবেষকেরা দেখলেন, উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন রোগী যাঁরা ধ্যান করছিলেন, তাঁদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি ও সার্বিক মৃত্যু প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছিল। এই তুলনাটি করা হয়েছিল আরেক দল রোগীর সঙ্গে, যাঁদের স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং জীবনযাপন সম্বন্ধে শিক্ষাদান করা হয়েছিল।
১০০ জন রোগী যাঁরা ধ্যানচর্চা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ২০টি। কেবল স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও জীবনযাপনের চর্চা যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তেমন ঘটনা ঘটেছিল ৩২টি।
ধ্যান যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা রোগমুক্ত থাকতে পেরেছিলেন আরও দীর্ঘকাল এবং গড়ে তাঁদের সিস্টোলিক রক্তচাপ কমে এসেছিল পাঁচ মিলিমিটার। ইনস্টিটিউট ফর ন্যাচারাল মেডিসিন অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিচালক রবার্ট স্নাইডার বলেন, রক্তচাপ হ্রাস পাওয়া ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই গবেষণাটি হয়েছিল সেই ইনস্টিটিউট এবং উইসকনসিন মেডিকেল কলেজের যৌথ প্রয়াসে। গবেষণাটি উপস্থাপন করেন রবার্ট স্নাইডার। মিলোকিতে অবস্থিত উইসকনসিন মেডিকেল কলেজের সঙ্গে মৌলিকভাবে যুক্ত ছিল ফেথারফিল্ড, আইওয়ার মহাঋষি ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট। মিলোকির অধিবাসীদের মধ্যে যাঁদের উচ্চ ঝুঁকি ছিল, যাঁদের অনেকে ছিলেন ওজনে ভারী বা স্থূল, তাঁরা স্বাভাবিক ওষুধের সঙ্গে তূরীয় ধ্যানচর্চা করে আগে দেখেছেন যে এতে রক্তচাপ অনেক হ্রাস পায়। তাঁদের অনেকের ছিল মাত্র হাইস্কুল পাসের বিদ্যা। তাঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ছিলেন ধূমপায়ী। বার্ষিক আয় ছিল ১০ হাজার ডলারের কম।
অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা সহজেই ধ্যান করা শিখতে পেরেছিলেন—বলেন স্নাইডার। সৌভাগ্যবশত এই ধ্যান করা শিখতে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয় না। জীবনযাপন, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে এর দ্বন্দ্ব হয় না। এই ধ্যান হলো মন ও শরীরের গভীর বিশ্রামের জন্য একটি সোজাসুজি পদ্ধতি।
স্নাইডার বলেন, এই কৌশল অবলম্বন করে শরীরের নিজস্ব ক্ষয় পূরণ, মেরামতি এবং স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা যায়।
স্নাইডার বলেন, এই মানসিক চাপ কমার পরপর ধ্যানচর্চার অন্যান্য সুফল পাওয়া যেতে থাকে। মাঝেমধ্যে ঘটে পরিবর্তন, কর্টিসোলের মতো স্ট্রেস হরমোন বাধাগ্রস্ত হয় এবং প্রদাহ প্রতিক্রিয়া দমে যায়। আর হূদরোগের বড় ব্যাপার এথারোসক্লেরোসিসের পেছনে রয়েছে প্রদাহ, প্রতিক্রিয়া তো বটেই।
উইসকনসিন মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল রিসার্চ বিভাগের অ্যাসোসিয়েট ডিন থিওডোর কোচেন বলেন, হূদবাহ রোগের পেছনে আছে মানসিক চাপ। এ সম্বন্ধে আরও কী জানা যায়? ‘হরমোন, নিউরাল হরমোন, কর্টিসোল, ক্যাটেকোলেসাইনস—এ সবই মানসিক চাপে উঁচু মানে পৌঁছে যায়।
তাহলে এগুলো কি কোনোভাবে হূদরোগ ও রক্তনালির রোগের পেছনে রয়েছে? তাই ধ্যানমগ্ন হয়ে এসব হরমোন কিছুটা হ্রাস করলে কি রোগ কমানো যাবে? এ কেবল চিন্তাভাবনার বিষয়। ভাবতে পারি কেবল।
আমেরিকান জার্নাল অব হাইপারটেনশন এই তূরীয় ধ্যানকে প্রধান উপজীব্য বিষয় করে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল। এতে তরুণ সুস্থ লোকদের ওপরই হয়েছিল গবেষণা। দেখা গেল, চাপগ্রস্ত কলেজ ছাত্রছাত্রীরা এই ধ্যান করে মনমেজাজ বেশ ভালো করল, আর যাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি ছিল, তাদেরও রক্তচাপ হ্রাস পেল। স্নাইডারও এই গবেষণায় যোগ দিয়েছিলেন, তাঁর গবেষণাটি হয়েছিল ওয়াশিংটনে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তিনি গবেষণার জন্য অন্তর্ভুক্ত করেন ২০৮ জন শিক্ষার্থীকে।
যেসব শিক্ষার্থীর উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি ছিল, এবং যারা ধ্যান অভ্যাস করেছিল, তাঁদের সিস্টোলিক চাপ কমেছিল ৬ দশমিক ৩ মিলিমিটার এবং ডায়াস্টোলিক কমেছিল গড়ে ৪ মিলিমিটার।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
ধ্যান ও হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, সাম্মানিক অধ্যাপক
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৩, ২০১০