দেহের চাহিদা অনুযায়ী না খেলে নানা সমস্যা হতে পারে ওজন কমাতে হবে। না খেয়ে থাকাই এর সমাধান—এমন ধারণা অনেকেরই আছে। তবে ধারণাটি একেবারেই ভুল। না খেয়ে হয়তো আপনি ওজন কমাতে পারবেন। কিন্তু দুর্বলতা, মাথা ঘোরা—এমন নানা সমস্যা জেঁকে বসবে। ওজন কমানোর সঠিক উপায় নিয়ে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক লুৎফুন্নাহার এবং রান্নাবিদ সিদ্দীকা কবীর।
‘কমবেশি সবাইকেই বলতে শোনা যায় যে ওজন কমানোর জন্য ডায়েট করছি। আসলে আমরা ভুল শব্দ ব্যবহার করছি। ডায়েট অর্থ খাবার। সেটা শিশু, তরুণী, যুবক, বৃদ্ধ সবার খাবার হতে পারে। শব্দটি হচ্ছে ডায়েট কন্ট্রোল বা খাবার নিয়ন্ত্রণ।’ বলছিলেন লুৎফুন্নাহার।
সিদ্দীকা কবীর বলেন, ‘আমাদের বয়স ও দেহের গঠন অনুযায়ী প্রত্যেকের খাবারের নির্দিষ্ট চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা অনুসারে খাবার গ্রহণ করা জরুরি। বেশি বা কম খাবার দুটিই আমাদের স্বাস্থ্যের জন ক্ষতিকর।
অর্থাৎ দেহের সৌন্দর্য ও গড়নের সঙ্গে খাবারের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। খাবার নিয়ন্ত্রণের সময় খেয়াল রাখতে হবে, দেহের চাহিদা সঠিকভাবে মিটছে কি না। খাবারে সব ধরনের পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি থাকতে হবে। খাবারে প্রোটিন, ভিটামিন, স্নেহ, আমিষ ইত্যাদি সব উপাদান থাকলেই কেবল সেটি সুষম খাবার হবে। সুষম খাবারটি হতে হবে আপনার দেহের উচ্চতা ও ওজন অনুযায়ী।’
যাঁরা ওজন কমাতে উঠে পড়ে লেগেছেন, তাঁদের জন্য লুৎফুন্নাহার বলেছেন, আমাদের শরীরে নানা খাদ্য উপাদানের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত প্রয়োজন রয়েছে। এর বেশি হলেই তখন তা শরীরে চর্বি হিসেবে জমে যায় এবং আমরা মুটিয়ে যাই। তাই দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা থেকে তেল ও মিষ্টিজাতীয় উপাদান নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ওজন কমানো যায়। কিন্তু হঠাৎ করে খুব কমিয়ে দিলে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন আপনি। তাই অল্প অল্প করে পরিমাণটা কমিয়ে আনুন।
ভাত, আটা, ময়দা—এসব উপাদানে বেশি ক্যালরি রয়েছে। তাই আগে যেখানে তিনটি রুটি খেতেন, সেখানে দুটি খান। ভাতের ক্ষেত্রেও তাই। ধীরে ধীরে ভাতের পরিমাণও কমিয়ে আনতে পারেন।
মিষ্টিজাতীয় খাবারেও ওজন বাড়ে। সে ক্ষেত্রে সাধারণ চিনির বদলে ক্যালরিমুক্ত চিনি খেতে পারেন।
তেলে ভাজা খাবার বর্জন করুন।
যেটুকু খাবার কমিয়ে দিচ্ছেন, সেই জায়গাটা ফলমূল ও সবুজ সবজি দিয়ে পূরণ করুন। গাজর, টমেটো, কাঁচা-পাকা পেঁপে, শসা রাখতে পারেন খাদ্যতালিকায়। দুধ, সবজি, ফলমূল খাদ্যতালিকা থেকে যেন বাদ না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। রাতে খাওয়া ছেড়ে দেন অনেকেই। রাতে একদম না খেয়ে থাকা স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর। কারণ ঘুমালে অনেক সময় ধরে দেহে কোনো খাদ্য উপাদান যায় না। রাতের খাবারে হালকা কিছু রাখুন। রাতের খাবার খেয়ে একটু হাঁটাচলা করুন, তারপর ঘুমাতে যান। দুপুরে ভরপেট খেয়ে ঘুম দিলে কিন্তু সর্বনাশ। ওজন কমাতে চাইলে দুপুরের আরামের ঘুমটির কথা একদম ভুলে যান। বিকেলে বন্ধুদের আড্ডায় শিঙাড়া না খেয়ে একটা আপেল খেয়ে নিন। গরমে প্রচণ্ড পিপাসা পেয়েছে? কোমল পানীয় না খেয়ে তাজা ফলের রস, ডাবের পানি খান। হাতের কাছে এ দুটি না পেলে শুধু ঠান্ডা পানি দিয়েই গলা ভেজান। কোনো অনুষ্ঠানে গেছেন? তেলযুক্ত খাবারের সঙ্গে নিশ্চয়ই সালাদও পাবেন। সালাদটা একটু বেশি পরিমাণে খান। লুৎফুন্নাহার আরও বলেন, প্রতিদিন সাধারণত আমাদের খাবারে ক্যালরির চাহিদা এক হাজার ৩০০ ক্যালরি। এটা উচ্চতা ও বয়সভেদে ২০০০-এর বেশিও হতে পারে। তবে আপনার খাবার নিয়ন্ত্রণের সময় খেয়াল রাখুন, সেটা যেন এক হাজার ৩০০ ক্যালরির কম না হয়। আর দৈনন্দিন পানির চাহিদা হলো দুই লিটার। দুই লিটারের কম নয় বরং সম্ভব হলে বেশি পানিই পান করুন।
সিদ্দীকা কবীর বলেন, আমরা বাঙালিরা রসনা বিলাসী। তেল, মসলা একটু বেশিই খাই। রান্নার সময় কিছু বিষয় খেয়াল করলে আমাদের খাবার নিয়ন্ত্রণের অর্ধেক ঝামেলা কমে যায়।
রান্নার সময় তেল একটু কম ব্যবহার করুন।
সাধারণ কড়াইয়ে তেল বেশি লাগে, তাই ফ্রাইপ্যান ব্যবহার করুন।
মাংস রান্নার আগে চর্বি ফেলে দিন।
ভাজা খাওয়ার প্রবণতা ছেড়ে সিদ্ধ খাওয়ার অভ্যাস করুন।
ঝোল করে তরকারি রান্না করুন, এতে তেল কম লাগে।
গোটা কোনো কিছু রান্না না করে কিমা করে নিতে পারেন।
সকালের নাশতায় পরোটার বদলে রুটি খান।
দুপুরের খাবারে মাছ ও মাংসের মধ্যে যেকোনো একটি উপাদান রাখুন।
খাবার টেবিলে আকর্ষণীয় করে সাজান সালাদের প্লেটটি। দেখবেন সবাই খেতে আগ্রহী হবে।
বিকেলের নাশতায় ডিম, তেল, মুরগির মাংস দিয়ে নুডল্স না করে মটরশুঁটি, গাজর, বরবটি দিয়ে সুপের মতো করে রান্না করে ফেলুন।
শুধু রান্না আর খাবার নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দিলেই হবে না, ওজন কমানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো ব্যায়াম। করতে পারেন যোগব্যায়াম। দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা হাঁটুন। আলাদা করে সময় বের করতে না পারলে বাইরে যে সময়ে বের হওয়া দরকার, তার একটু আগে বের হোন। রিকশার পথটুকু হেঁটে যান, আর ফেরার পথে বিকেলের বাতাস খেতে খেতে হেঁটে আসুন বাসায়। ওজন কমানো এ আর এমন কঠিন কী!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৫, ২০১০