আধুনিক সভ্যতা আমাদের উপহার দিয়েছে নগরায়ণ। মানুষ গ্রাম থেকে আসছে শহরে ও নগরে। বিশ্বজুড়ে এমনটা ঘটছে। স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। সম্মিলিতভাবে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে স্বাস্থ্যের ওপর নগরায়ণের প্রভাব আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে এখন প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ বাস করে নগরে।
২০০৭ সালে ইতিহাসে এই প্রথম নগরে বিশ্বের যত লোক বাস করেন, তা ছাড়িয়ে গেছে শতকরা ৫০ ভাগ।
২০৩০ সালের মধ্যে ১০ জনের মধ্যে ছয়জন হবেন নগরবাসী, ২০৫০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ১০ জনে সাতজন।
অনুমান করা যায়, নগরায়ণ হবে জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। একে মোকাবিলা করতেই হবে।
অনেকে বলছেন, আগামী ৩০ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটবে পুরোটাই নগরে। তাই নগরায়ণ এসেছে থাকতে, নগরায়ণ থাকছেই।
আর এর সঙ্গে যুক্ত হবে জল, পরিবেশ, আঘাত, ক্ষত, সন্ত্রাস, অসংক্রামক রোগ, ধূমপান ও তামাক সেবন, অস্বাস্থ্যকর খাবার, শরীরচর্চার অভাব, মদ্যপানের কুপ্রভাব—এসব সমস্যার জন্য স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ। নানা কারণেই নগরায়ণ হয়ে উঠছে বড় রকমের চ্যালেঞ্জ।
নগরের দরিদ্র মানুষ বৈষম্যের শিকার হয় নানাভাবে, রোগভোগ বেশি, রোগের সংখ্যাও বেশি, চিকিৎসাও আয়ত্তের মধ্যে কম। এ ছাড়া রয়েছে অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা। যেমন— সন্ত্রাসের শিকার হয় তারা বেশি, ক্রনিকরোগ এবং কিছু সংক্রামক রোগ, যেমন—যক্ষ্মা, এইচআইভি/এইডসের শিকারও হয় তারা বেশি।
নাগরিক পরিবেশে স্বাস্থ্যের মূল চালিকাগুলো বা সামাজিক নির্ণয়কগুলো স্বাস্থ্য খাতের মূল আওতার মধ্যে নেই, স্বাস্থ্য অবকাঠামোকেও ছাড়িয়ে যায় সমস্যাগুলো, সামাজিক ও স্বাস্থ্য পরিষেবা, স্থানীয় প্রশাসন, অর্থনৈতিক অবস্থা ও শিক্ষার সুযোগ—সবকিছু মিলিয়েই চ্যালেঞ্জকে বুঝে এরপর মোকাবিলা করতে হবে।
নগরের স্বাস্থ্যের এসব চ্যালেঞ্জের মূল কারণগুলো মোকাবিলার জন্য কী উপায়?
নগর পরিকল্পনা সঠিকভাবে করলে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসম্মত আচরণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। নগরে যানবাহন সুপরিকল্পিত হলে, খেলাধুলা ও ব্যায়ামের জন্য মাঠ রাখলে, সবুজ পার্ক রাখলে, পায়ে চলার পথ রাখলে, তামাক সেবন ও নিরাপদ খাদ্যের ওপর আইনি নিয়ন্ত্রণ থাকলে ও এর সঠিক প্রয়োগ থাকলে নাগরিকের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।
নগরের বাসস্থান, পানীয়জলের সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ক্ষেত্রে নাগরিক জীবনযাপন উন্নত হলে অনেক স্বাস্থ্যঝুঁকি কমে আসবে।
এসব কাজের জন্য যে সব সময় প্রচুর অর্থ লাগে তা নয়, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, দায়বদ্ধতার অভাব হলে বাজেটে অর্থ থাকলেও তা খরচ করার ক্ষমতা অনেকের থাকে না, উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে দায়বদ্ধ হলে অগ্রাধিকারের দিকগুলো সম্পদকে ও শক্তিকে প্রবাহিত করলে সুফল লাভ সম্ভব।
২০১০ সালের ৭ এপ্রিল পালিত হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। সেই দিবস পালনের থিম নির্ধারণ করা হয়েছিল ‘নগরায়ণ ও স্বাস্থ্য’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ দিবস পালনের মাধ্যমে নগরায়ণের যেসব স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে সে সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করবে, নগর পরিকল্পনা ও পরস্পরের মধ্যে সংযোগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য জনগণ, সরকার ও অন্যান্য সংস্থাকে অবহিত করবে।
নগরায়ণের যেসব বড় বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, যেমন—পরিবেশ দূষণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্যব্যবস্থাপনা—সেগুলো মোকাবিলা করার ব্যবস্থা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
যেসব ঝুঁকির মুখোমুখি অনবরত হওয়ার জন্য অসংক্রামক ব্যাধিগুলো হয়, যেমন—তামাক সেবন, অস্বাস্থ্যকর খাবার, শরীরচর্চার অভাব, মদ ও নেশার ওষুধ গ্রহণ—এই ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করা একটি বড় কাজ।
সংক্রামক ব্যাধি যেমন—এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, বিশ্বমারী ইনফ্লুয়েঞ্জা (এইচ১এন১) এদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসের মধ্যে জীবন—একে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা।
নগরে যান দুর্ঘটনাকে মোকাবিলা করা।
জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি যেমন—মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবিক সংকট মোকাবিলা।
নগরে নাগরিকদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সিটি করপোরেশন দায়িত্ব নিলে নগরবাসীর স্বাস্থ্য আরও উন্নত হবে, জীবনযাপনের উন্নতি হলে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হবে, সমন্বিত জনস্বাস্থ্যনীতি গ্রহণে উন্নতির অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৩, ২০১০