তোতলানো একটা কথা বলার সমস্যা, যেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভালো হয়ে যায়। সাধারণত ১৬ বছর বয়সের আগেই শতকরা ৮০ ভাগ ভালো হয়ে যায়।
হালকা-পাতলা তোতলানোর কোনো বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু বেশি মাত্রায় যারা তোতলায়, তাদের স্পিচ থেরাপির (শব্দ উচ্চারণের চিকিৎসা) মাধ্যমেই চিকিৎসা করে উন্নত করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে ২২ অক্টোবর পালিত হলো আন্তর্জাতিক তোতলানো দিবস।
সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যই এর মূল উদ্দেশ্য। তোতলানো হলো কথা বলার সমস্যা। অর্থাৎ কথা বলার সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে তিনটি ব্যাপার হতে পারে।
–শব্দ বা কথা পুনরাবৃত্তি করা। যেমনঃ আগামী আগামী আগামীকাল যাব।
–শব্দের প্রথম অক্ষর বা উচ্চারণ লম্বা করে বলা, যেমনঃ পাপাপাপাপানি খাব।
–বাক্যের মধ্যে বা শব্দের মধ্যে হঠাৎ করে থেমে যাওয়া বা আটকে যাওয়া। মুখ নড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। ঠোঁট-মুখ বেঁকে যাচ্ছে, মুখ থেকে হালকা থুতু বের হচ্ছে, কিন্তু কথাটা পুরো হচ্ছে না-এই তিনটাই প্রাথমিক সমস্যা। এগুলো যখন স্বাভাবিক হচ্ছে না, তখন পরবর্তী পর্যায়ে তার মধ্যে তৈরি হচ্ছে হতাশা, লজ্জা ও দুশ্চিন্তা। এভাবে বৃত্তের মতো ঘুরতে থাকে এবং সমস্যা জটিল হতে শুরু করে, ফলে তোতলানো তো কমেই না, বরং দিন দিন বাড়তে থাকে।
তোতলানো কাদের হয়ঃ কম-বেশি সবারই হতে পারে। সাধারণত মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের তিন-চার গুণ বেশি হয়। তোতলানোর তালিকায় বিখ্যাত অভিনেতা, রাজনৈতিক নেতা, গায়ক, গায়িকা, খেলোয়াড়, লেখক, বিজ্ঞানীসহ সবারই নাম পাওয়া যায়।
কারণঃ যুগের পর যুগ তোতলানোর কারণ খোঁজা হয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধারণা করা হয়েছে।
গ্রিক যুগে ধারণা করা হতো যে জিভ শুকিয়ে গেলে হয়। সে জন্য বিভিন্ন পানীয় ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বিশেষ কোনো কাজ হয়নি।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভাবা হতো, জিভের নিচে একটি বাড়তি মাংস থাকায় জিভ নড়ে না। চিকিৎসা হিসেবে বহু রকমের অপারেশন করা হয়েছে, কিন্তু তার পরও কোনো উন্নতি হয়নি।
বিংশ শতাব্দীতে মনে করা হয়েছে যে মানসিক চাপ বা রোগের জন্য এটা হয়। সে জন্য মানসিক চাপ নিরাময়ের জন্য বহু ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। বর্তমান যুগে ভাবা হয় যে কথা বলার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় এ রকম হয়। আর এ জন্য শব্দ উচ্চারণের বিভিন্ন ধরনের থেরাপিই একমাত্র চিকিৎসা।
তোতলানোর প্রকারভেদঃ দুই ধরনের তোতলানো দেখা যায়-
বাড়ন্ত বয়সে কথা বলার সমস্যা
এটা সাধারণত শিশুদের হয়। এরা পুরা শব্দ বা বাক্যটা পুনরাবৃত্তি করে। এটা কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
সাধারণ তোতলানোঃ এরা শব্দের প্রথম আওয়াজটা পুনরাবৃত্তি করে বা আওয়াজটা লম্বা করে অথবা বাক্যের মধ্যে থেমে যায় এবং মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমা হয়।
চিকিৎসাঃ তোতলানো অল্প হলে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। একটু সচেতন হলেই এটা দূর করা সম্ভব।
আরও যা করণীয়
–কখনো তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবেন না।
–তার সঙ্গে কথা বলুন বারবার। তার লজ্জা, হতাশা ও দুশ্চিন্তা কমান।
–তাকে ধীরে ধীরে কথা বলার অভ্যাস করান।
–প্রতিটি আওয়াজ ধীরে ধীরে ও চাপ দিয়ে বলার অভ্যাস করান।
একটু সচেতন হলেই তোতলানোর সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। প্রয়োজন শুধু সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ।
ডা· সেলিনা ডেইজী
শিশু নিউরোলজি ও ক্লিনিক্যাল নিউরোফিজিওলোজি বিশেষজ্ঞ
স্মায়ুরোগ বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৯, ২০০৮