ড· জাকিয়া বেগম
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন
সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের জন্য থাইরয়েড হরমোন অপরিহার্য। জ্নের সময় নবজাতকের মধ্যে এই হরমোনের স্বল্পতাজনিত সমস্যাকে জ্নগত হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়। উন্নত দেশের সমীক্ষায় দেখা গেছে, চার হাজার নবজাতকের মধ্যে অন্তত একজন থাইরয়েড হরমোনের তীব্র ঘাটতিসহ জ্ন নেয়। কম তীব্রতা অথবা আংশিক তীব্রতা নিয়ে জন্মানো শিশুর সংখ্যা এর চেয়ে বেশি।
আমাদের দেশে এখনো তেমন কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয়, এ সংখ্যা উন্নত বিশ্বের প্রায় দ্বিগুণ। এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া না হলে শিশু শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে। আক্রান্ত শিশুর বেশির ভাগের আইকিউ ক্ষমতার মাত্রা ৮০-র নিচে থেকে যেতে দেখা যায়।
খুব সহজে ও সুলভে হাইপোথাইরয়েডিজম রোগটি নির্ণয় এবং এর ফলপ্রসূ চিকিৎসাও করা যায়। প্রায় সব উন্নত দেশেই স্ক্রিনিং পদ্ধতিতে নবজাতকের জ্নের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রোগটি নির্ণয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
কারণ চিকিৎসার অভাবে একবার শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হয়ে গেলে পরে চিকিৎসা দিলেও শিশু আর সুস্থ নাও হতে পারে। জ্নের চার সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসা দিলে এ রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
খাবারে আয়োডিনের স্বল্পতা রোগটির প্রধান কারণ। থাইরয়েড-গ্রন্থির সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি, গঠনগত ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা, জেনেটিক ত্রুটির ফলে থাইরয়েডের থাইরক্সিন হরমোনের সংশ্লেষণজনিত ত্রুটি, ভ্রূণ অবস্থায় কোনো কীটনাশক বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসা, অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে হরমোন-উত্তেজক উপাদানের (টিএসএইচ) স্বল্পতা ছাড়া অন্য কোনো কারণেও এ রোগ দেখা দিতে পারে।
এ রোগে আক্রান্ত অনেক নবজাতকের মধ্যে লক্ষণের তেমন কোনো প্রকাশ ঘটে না বলে তিন মাস বয়স পর্যন্ত আক্রান্ত অনেক শিশুকেই স্বাভাবিক বলে ভুল হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো এত মৃদু থাকে যে সেগুলো সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। তবে যেসব লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে সেগুলো হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ঘুম, মাংসপেশির দুর্বলতাজনিত অসাড়তা, কান্নার শব্দ কর্কশ অথবা খুব ক্ষীণ, দুধপানে অনীহা, খুব কম পায়খানা, উচ্চমাত্রায় জন্ডিস হওয়া, শরীরের তাপমাত্রা কম থাকা প্রভৃতি।
হরমোনের মারাত্মক ঘাটতির কারণে মাথার তালুর সামনের অংশ বৃহদাকার হয়ে ওঠা, তালুর পেছনের অংশ অনড় হয়ে থাকা, অস্বাভাবিক বড় জিভ, নাভির সঙ্গে যুক্ত নালিটি স্কীত হওয়া প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
জ্নের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে থাইরয়েড উত্তেজক হরমোন (টিএসএইচ) অথবা থাইরক্সিনের (টি-৪) মাত্রা পরীক্ষা করে রোগটি শনাক্ত করা হয়। টিএসএইচের মাত্রা বেশি অথবা টি-৪-এর মাত্রা কম থাকলে নবজাতক জন্মগত হাইপোথাইরয়েড রোগে আক্রান্ত বলে ধরা হয়।
কখনো কখনো গ্রন্থিটির গঠনগত ত্রুটি নির্ণয়ের জন্য টেকনিশিয়ান দিয়ে থাইরয়েডের স্ক্যানিং করার প্রয়োজন হয়। জ্নের পর ফুলের দিকে নাড়ির যে অংশ থাকে তা থেকে অথবা নবজাতকের পায়ের গোড়ালি থেকে এক ফোঁটা রক্ত সংগ্রহ করে হরমোনের মাত্রা নির্ণয় করা যেতে পারে।
হাইপোথাইরয়েডিজম অস্থায়ী বা স্থায়ী হতে পারে। রোগের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে জ্নগতভাবে এ রোগে আক্রান্ত শিশুরাও সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে।
এমনকি গ্রন্থিটির সম্পূর্ণ অনুপস্থিতির কারণে টি-৪ হরমোন তৈরি সম্ভব না হলেও শিশুরা প্রায় স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। এ রোগের প্রধান চিকিৎসাপদ্ধতি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় শরীরে প্রতিদিন থাইরয়েড হরমোন প্রয়োগ করা, যা সাধারণত সেবন করানো হয়।
নিয়মিত হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখতে হয় এবং সঠিক মাত্রা বজায় রাখার জন্য শিশুটি বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত হরমোনের মাত্রা বাড়াতে হয়।
দুঃখের বিষয়, সহজে ও সুলভে রোগটি নির্ণয় এবং এর চিকিৎসা থাকলেও শুধু অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে আমাদের দেশের অনেক শিশুকেই প্রতিবন্ধী হিসেবে অভিশপ্ত জীবন বরণ করে নিতে হচ্ছে।
উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত নবজাতকদের শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন নবজাতকদের মধ্যে জ্নগত হাইপোথাইরয়েড রোগ শনাক্তকরণ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন পরমাণু চিকিৎসাকেন্দ্রে এ রোগে আক্রান্ত নবজাতকদের শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদান কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
কিন্তু উচ্চ জন্মহারের এ দেশে শুধু পরমাণু শক্তি কমিশনের পক্ষে সব নবজাতককে এ প্রকল্পের আওতায় আনা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই প্রতিবন্ধিত্বের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত রাখার প্রচেষ্টা অনেকাংশেই সফল হয়ে উঠতে পারে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৩, ২০০৮