Daffodil Computers Ltd.

E-Health / Protect Your Health => E- Health For Child => Topic started by: bbasujon on January 12, 2012, 06:49:19 AM

Title: অটিজমঃ শিশুর মনোবিকাশের প্রতিবন্ধক
Post by: bbasujon on January 12, 2012, 06:49:19 AM
অটিজম কী?: অটিজম হচ্ছে শিশুদের একটি মনোবিকাশগত জটিলতা, যার ফলে সাধারণত তিনটি সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, মৌখিক কিংবা অন্য কোনো ধরনের যোগাযোগের সমস্যা; দ্বিতীয়ত, সামাজিক বিকাশগত সমস্যা এবং তৃতীয়ত, খুব সীমাবদ্ধ ও গণ্ডিবদ্ধ জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করা। এ ছাড়া অতি চঞ্চলতা, জেদি, আক্রমণাত্মক আচরণ, অহেতুক ভয়ভীতি, খিঁচুনি ইত্যাদিও থাকতে পারে।

কীভাবে শনাক্ত করা যায়ঃ সাধারণত শিশুর বয়স ১৮ মাস থেকে তিন বছরের মধ্যে এই রোগ শনাক্ত করা যায়। যত দ্রুত রোগটি শনাক্ত করা যায়, শিশুর জন্য ততই ভালো। সাধারণত যেসব বৈশিষ্ট্য দেখে অটিস্টিক রোগটি শনাক্ত করা তা হলো-

    শিশুর ভাষার বিকাশ হতে বিলম্ব হয় (এক বছর বয়সে অর্থবহ অঙ্গভঙ্গি, ১৬ মাস বয়সে একটি শব্দ এবং দুই বছর বয়সে দুই শব্দের বাক্য বলতে পারে না)।
    সমবয়সী কিংবা অন্যদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না।
    নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না এবং আপন মনে থাকতে পছন্দ করে।
    অন্যদের চোখের দিকে তাকায় না। অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না।
    একই কথা পুনরাবৃত্তি করে এবং একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে।
    কখনো কখনো অতি সক্রিয়, আবার কখনো কখনো খুব কম সক্রিয়। অতি সক্রিয়তা থেকে কখনো কখনো খিঁচুনি হতে পারে।
    সাধারণত খেলনা দিয়ে কোনো গঠনমূলক খেলা খেলতে পারে না অথবা কোনো বিশেষ খেলনার প্রতি অতিরিক্ত মোহ দেখা যায়
    কখনো মনে হতে পারে যে শিশুটি কানে শুনতে পাচ্ছে না।
    মাকে বা অন্য কোনো প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরে না এবং তাদের কেউ ধরলেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না অথবা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়।
    কখনো কখনো আত্মপীড়ন করে এবং মনে হয় তাতে সে তেমন কষ্ট পাচ্ছে না।
    কোনো বিশেষ কিছুর প্রতি অত্যধিক আকর্ষণ থাকে, যেমন-কাগজ ছেঁড়া, পানি বা তরল পদার্থ দিয়ে খেলা, চাল বা ডাল দানাদার কিছু দিয়ে খেলা ইত্যাদি।
    সাধারণত কল্পনাপ্রসূত খেলা খেলতে পারে না।
    কোনো বিশেষ সংবেদনের প্রতি অস্বাভাবিক আচরণ করে, যেমন-আলোতে চোখ বন্ধ করা, শব্দ শুনলে কানে হাত দেওয়া, দুর্গন্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া না করা, স্বাদ ও স্পর্শে তেমন কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ না করা ইত্যাদি।

কারণঃ অটিজমের সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। মনোবিকাশের প্রতিবন্ধকতার কারণ হিসেবে মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক জৈব রাসায়নিক কার্যকলাপ, মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক গঠন, বংশগতির অস্বাভাবিকতা, এমনকি বিভিন্ন টিকা প্রয়োগ থেকে এই রোগ হতে পারে বলা হলেও নির্দিষ্ট করে কিছু এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তবে জ্ন-পরবর্তীকালের কোনো জটিলতা কিংবা শিশুর প্রতি অমনোযোগিতার ফলে এ রোগের সৃষ্টি হয় না। কাজেই মা-বাবা বা অন্য কোনো অভিভাবকদের দায়ী করার কোনো কারণ নেই।

চিকিৎসাঃ অটিজম একেবারে সারিয়ে তোলার জন্য কোনো চিকিৎসা এখনো নেই। তবে বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, মা-বাবা ও আপনজনদের শ্রম, যত্ন এবং এ রোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সহায়ক দলের একত্রে কার্যক্রমে শিশুর বিকাশ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলেও একটি শিশুকে স্বাধীন জীবনযাপন করার মতো পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়। আর এ জন্য যা করণীয়, তা হচ্ছে-

    শিশুর মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুটিকে সার্বক্ষণিক সহায়তা প্রদান।
    কিছু ওষুধপত্র প্রয়োগ, যা তার অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে।
    দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া; যা শিশুটির ভাষা বিকাশ, সামাজিক বিকাশ, স্বাবলম্বিতার বিকাশ, বিশেষ দক্ষতার বিকাশ এবং অন্যান্য স্বকীয়তা অর্জনে সহায়তা করবে।
    সামাজিক স্বীকৃতি এবং সবার সহযোগিতা এ ধরনের শিশুর বিকাশের জন্য খুবই জরুরি। সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশে বেশির ভাগ লোকই এখনো এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানে না।

অটিস্টিক শিশুরা প্রতিবন্ধী নয়ঃ অটিস্টিক শিশুরা কখনো কখনো বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হয়। যথাযথভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে এসব শিশু। তাই এরা প্রতিবন্ধী নয়।

রোগের বিভিন্ন পর্যায়ঃ সাধারণত অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের চারটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। বয়সের সঙ্গে নয়, বরং প্রতিটি শিশুর সামর্থ্যের ওপর তার পর্যায় নির্ভর করে। পর্যায়গুলো হলোঃ

    প্রথম পর্যায়-আত্মকেন্দ্রিক স্তরঃ এ পর্যায়ে শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক থাকে এবং আপন মনে একাকী খেলতে পছন্দ করে। সাধারণত কোনো আদেশ-নিষেধ অথবা নির্দেশ বুঝতে পারে না ও পালন করে না।
    দ্বিতীয় পর্যায়-অনুরোধকারী স্তরঃ এ পর্যায়ে শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে খুব কাছের লোকদের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য যোগাযোগ স্থাপন করে এবং তাদের চাহিদা পূরণ করার জন্য অনুরোধ করে।
    তৃতীয় পর্যায়-যোগাযোগ শুরুকারী স্তরঃ এ পর্যায়ের শিশুরা কিছু প্রচলিত শব্দ বুঝতে পারে এবং অতি পরিচিত মানুষের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। ছোটখাটো আদেশ-নির্দেশ পালন করতে পারে।
    চতুর্থ পর্যায়-সহযোগী স্তরঃ এ পর্যায়ের শিশুরা পরিচিত সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য খেলা করে। ভাষায় দক্ষতা একটু ভালো এবং অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।

অটিস্টিক শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়াঃ উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশে অটিস্টিক শিশুদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে আমাদের দেশেও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ ধরনের শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। তবে মানসম্পন্ন তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি-এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। অনেক দেশেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো সাধারণত এ ধরনের শিশুদের মা-বাবারা পরিচালনা করে থাকেন। কাজেই অটিজম শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো অত্যন্ত জরুরি। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর উচিত কত দ্রুত শিশুটিকে একপর্যায় থেকে অন্যপর্যায়ে উন্নত করা যায়, সে জন্য সচেষ্ট হওয়া। এ ছাড়া মা-বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্য ও পরিচর্যাকারীরা শিশুকে যে বিষয়গুলো প্রশিক্ষণ দেবেন তা হলো-

    স্বাবলম্বিতা বিকাশঃ বেঁচে থাকার জন্য যে কাজগুলো করা অবশ্যই দরকার, সেগুলো প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যেমন-টয়লেটে যাওয়া ও পরিচ্ছন্ন হওয়া, কাপড় ও জুতা পরা, দাঁত ব্রাশ করতে পারা, মাথা আঁচড়াতে পারা, নিজে নিজে খেতে পারা ইত্যাদি। খাওয়ার ও ঘুমের প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে যাতে খুব বেশি খেয়ে মুটিয়ে না যায় আর দিনের বেলা ঘুমিয়ে রাতে নিজে এবং অন্যের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায়।
    সংবেদনশীলতার সমন্বয়ঃ অটিস্টিক শিশুদের সংবেদনশীলতা অত্যন্ত প্রখর অথবা অপ্রতুল হওয়ায় তাদের সংবেদনশীলতার সমন্বয় না করা হলে কোনো কিছু শিখতে কিংবা মনোসংযোগ করতে অনেক বিলম্ব হয়। প্রশিক্ষণের জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে।
    ফিজিও অকুপেশনাল প্রশিক্ষণঃ অনেক অটিস্টিক শিশুর বিভিন্ন মাংসপেশি, চোখ ও হাতের যথাযথ সমন্বয় এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যথাযথভাবে পরিপক্বতা ও পরিপূর্ণতার ঘাটতি থাকে। যথাযথ ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি প্রয়োগ করলে এসব ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরী ফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে।
    কথা ও ভাষা বিকাশঃ অটিস্টিক শিশুদের কথা বলা ও ভাষা প্রশিক্ষণ অন্যদের চেয়ে বেশ কঠিন। কারণ তাঁরা চঞ্চল এবং বেশিক্ষণ মনোসংযোগ করতে পারে না। কথা ও ভাষা শিক্ষণের জন্য কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। যেমন-

শিশুদের সঙ্গে মুখোমুখি এবং একই উচ্চতায় ও চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে। ঠোঁটের নড়াচড়া এবং চোখ ও হাতের সঞ্চালন অনুসরণ করতে সাহায্য করতে হবে। যেকোনো কার্যক্রম করার সময় শিশুর সঙ্গে কথা বলে কাজটি করতে হবে এবং শিশুকে দিয়ে করানোর চেষ্টা করতে হবে। স্বাভাবিকভাবে শিশুটি কোনো শব্দ উচ্চারণ করলে তাকে অর্থপূর্ণ শব্দে রূপান্তর করার চেষ্টা করতে হবে।
শুরুতে বেশি দরকারি এক শব্দের কিছু সহজ কথা নির্বাচন করে সেগুলো শেখানোর চেষ্টা করতে হবে। যেমন-মা, বাবা, পানি, ভাত, জামা, জুতা, বই, বল ইত্যাদি। শেখানো কথাগুলো বারবার এবং প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই শিশুটি শিখে ফেলা শব্দগুলো ভুলে যেতে না পারে। এর সঙ্গে এক শব্দের সঙ্গে আরেকটি শব্দ যুক্ত করে দুই শব্দের বাক্য শেখানোর চেষ্টা করতে হবে। যেমন-পানি খাব, জামা দাও, বই দাও, বল নেব ইত্যাদি।

সামাজিকতা ও আচরণগত বিকাশ
অটিস্টিক শিশুদের প্রয়োজনীয় সামাজিক আচরণ শেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে যা করতে হবে তা হলো-

    সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে মিশতে ও ভাবের আদান-প্রদান করতে সহায়তা করতে হবে।
    কখনোই একাকী খেলতে দেওয়া যাবে না। কারও সঙ্গে খেলতে দিতে হবে এবং একে অন্যের মাধ্যমে কোনো কিছু আদান-প্রদান করা শেখাতে হবে।
    সম্ভাষণ করতে পারা, হাসির জবাবে হাসি, আনন্দ প্রকাশ, করমর্দন, সালাম প্রদান, বিদায়সূচক হাত নাড়া, শারীরিক স্পর্শের মাধ্যমে বন্ধুত্ব করতে পারা ইত্যাদি শেখাতে হবে।
    আদান-প্রদানমূলক খেলা, যেমন-বল দেওয়া-নেওয়া, গাড়ি দেওয়া-নেওয়া ইত্যাদি নিয়ম করে শিশুদের সঙ্গে খেলতে হবে। প্রথমে সহজ যেমন লুকোচুরি, টুকি ইত্যাদি থেকে আস্তে আস্তে গঠনমূলক খেলা খেলতে হবে।
    শিশুকে খেলার মাঠে বা পার্কে নিয়ে যেতে হবে এবং সহজভাবে চলাফেরা করতে দিতে হবে।
    তত্ত্বাবধানের সঙ্গে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অন্যদের সঙ্গে খেলায় সক্রিয় অংশ নেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।
    শিশুটিকে সব সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে হবে।
    ‘এটা ধোরো না’, ‘ওটা কোরো না; সারাক্ষণ এজাতীয় নিয়ন্ত্রণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
    কেউ যেন শিশুটিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে, বিরূপ সমালোচনা না করে এবং কোনো কঠিন আচরণ না করে, তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

—————————
ডা. মারুফা আহমেদ ও
লে. কর্নেল মো. তোফায়েল আহমেদ
প্রথম আলো, ২ এপ্রিল ২০০৮