শীতের পর্ব শুরু হয়ে গেছে। তবে শেষ রাতের ঠান্ডা অনুভূতি বেলা বাড়তে থাকলেই মিইয়ে আসে। আর এই না গরম না ঠান্ডার দিনে খাওয়া, পরা থেকে ঘুম, গোসল সবকিছুতেই বেশি ভোগে শিশুরা। শীতে এই কাবু তো একটু পরেই দৌড়-ঝাঁপে ঘেমেনেয়ে একাকার। টিফিনের প্রিয় খাবার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, নুডুলসটাও ঠান্ডা; ভালো খেতে চায় না। শীতের কড়া রোদে বাড়ি ফেরা-অবেলায় গোসল; সার্দি, জ্বরে কাবু। শত রকম সমস্যার সমাধানে থাকল বিশেষজ্ঞের পরামর্শসহ সচেতন মায়েদের জন্য শীতে শিশুর যত্নবিষয়ক হরেক রকম টিপস।
কী খাবে?
‘এ শুষ্ক ঋতুতে শরীর সুস্থ রাখার জন্য বেশি তরল খাওয়া জরুরি। শুধু পানি বারবার বাচ্চারা খেতে চায় না। দিতে পারেন মৌসুমি ফলের রস, দুধ ও স্যুপ। তবে বাজারে পাওয়া যায় এমন জুস ও কোমলপানীয় শিশুদের বেলায় একদম নিষেধ। বেশি খাবে মৌসুমি ফল, সবজি।’ বললেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি মহাবিদ্যালয়ের শিশুবর্ধন ও পারিবারিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক মওসউফা হক। মৌসুমি ফল, সবজি শিশুর রোগবালাই কমায়, পুষ্টির পাশাপাশি খাবারেও বৈচিত্র্য আনে। একেবারে ছোট শিশুদের (শূন্য থেকে এক বছর) কোনো খাবার দেওয়ার সময় খেয়াল রাখা দরকার সে কীভাবে তা নিচ্ছে। ছোট বাচ্চারা এক খাবার বারবার খেতে চায় না। তাদের খাবার তৈরির সময় এর গন্ধ, বর্ণ, স্বাদে বৈচিত্র্য আনুন। যারা স্কুলে নতুন যাচ্ছে, তাদের টিফিনে সহজপাচ্য এবং খেতে সুবিধা এমন খাবার দিন। ঘরে বানানো মিষ্টি, ফল, স্যান্ডউইচ, জুসসহ বাচ্চার মত নিয়েও তার পছন্দমতো খাবার দিতে পারেন। তবে তার উপকারিতাও জেনে নিতে হবে। ‘বাচ্চার খাবারটা টাটকা ও গরম হওয়া ভালো। ডায়রিয়া হলেও তাকে সব ধরনের স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে। নয়তো শিশু দুর্বল হয়ে পড়বে।’ বললেন সিরাজদি খানের (মুন্সীগঞ্জ) শিশু স্বাস্থ্য ক্লিনিকের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এফসিপিএস প্রশিক্ষণার্থী ডা· প্রবীর কুমার সরকার।
কী পরবে?
দিনে যেহেতু অপেক্ষাকৃত কম শীত লাগে, তাই শিশুকে হাফহাতা কাপড় পরানোই ভালো। তবে বাইরের ঠান্ডা বাতাস যেন খুব একটা না লাগে সেদিকে নজর দিতে হবে। ‘রাতে বাচ্চারা গায়ের কাঁথা ফেলে দেয়’-এ অভিযোগ অধিকাংশ মায়েরই। তাই বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েই এর সমাধানে সুতির হাতওয়ালা টি-শার্ট পরিয়ে রাখতে পারেন। তবে উল, ফ্ল্যানেলে ঘাম হয়। দীর্ঘ সময় এসব কাপড় না পরানোই ভালো। ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক সুতির মোটা কাপড়ই এ ঋতুর উপযোগী। মনে রাখবেন, অতিরিক্ত কাপড়ে ঘাম হয়। তা থেকেও শরীর খারাপ হতে পারে। শীতে ধুলাবালি বেশি থাকে। বাচ্চারা বাইরে বেরোনোর আগে যেন জুতা, মোজা পরে নেয়, সেদিকে নজর রাখুন। সঙ্গে রোদ থেকে বাঁচাতে টুপি, রোদচশমা চাই-ই।
ত্বকের যত্ন
শীত এলেই শরীরে সরিষার তেল মেখে রাখাটা কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত ও স্বাস্থ্যকর জানালেন ডা· প্রবীর। ‘তেল শরীরের জন্য উপকারী-এ বিষয়টি চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রমাণিত হয়নি। তেল যদি মাখতেই চান, তবে ভালো হবে জলপাই তেল, ভ্যাসলিন ও গ্লিসারিন।’ ‘সমপরিমাণ পানি ও গ্লিসারিনের মিশ্রণও শিশুর ত্বক ভালো রাখবে।’ বললেন মওসউফা হক।
মেয়েশিশুদের বড় চুলে তেল মাখতে চাইলে রাত নয়, দিনটাই ভালো। তবে রাতে তেল লাগানোটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে শিশুর ক্ষতি নাও হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ভালো ব্র্যান্ডের বেবি লোশন বাচ্চার ত্বকের যত্নে বেছে নিন। গায়ে যেন ধুলো-ময়লা লেগে না থাকে এদিকে নজর দিন। শীতেও নিয়মিত গোসল করা উচিত। এক দিন পরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে বাচ্চাকে গোসল করিয়ে দিন। লক্ষ রাখুন কোন সময়ে গোসল করলে বাচ্চা স্বস্তি বোধ করে।
অসুখ হলে
না ঠান্ডা না গরমের দিনে কাশি, শ্বাস নিতে কষ্ট, নাক বন্ধ, ডায়রিয়া, জ্বর-এসব অসুখ হতেই পারে। ঘাবড়ে যাবেন না। প্রথম অবস্থাতেই প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। নবজাত শিশু প্রতি মিনিটে ৪০ থেকে ৬০ বার শ্বাস নেয়। পরীক্ষা করুন শ্বাস-প্রশ্বাস কম-বেশি কি না। অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস খাদ্য গ্রহণেও অনীহা সৃষ্টি করে। জ্নের ২৮ দিন পর্যন্ত কোনো ওষুধই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দেবেন না। একটু বড় শিশুর ক্ষেত্রে গলাব্যথা, ঢোক গিলতে কষ্ট হলে কুসুম গরম পানি খাওয়ান। দিতে পারেন অল্প লিকারের লেবু বা আদা চা। ঠান্ডাজনিত কারণে ত্বকের যে অস্বস্তি তাও দূর হবে, খাবারে রুচি আসবে। পুরো শীতে নিয়ম করে খাওয়ান মধু ও তুলসীর মিশ্রণ। সঙ্গে এক চামচ গরম পানি মিশিয়ে নিলে ভালো হবে। ঘরে ধূমপান করলে বাচ্চার অসুখ বেড়ে যায়। তাই এ ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে। শীতের রাত যেহেতু বড়, তাই ঘুমানোর আগে কিছু খাওয়াতে ভুলবেন না। শিশুরা নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে পারে না। তাই পরিবারের সবাইকে তার ব্যাপারে নজর দিতে হবে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, ০৮ জানুয়ারী ২০০৭