Author Topic: শান্তিময় হোক শেষ দিনগুলো  (Read 4767 times)

bbasujon

  • Administrator
  • VIP Member
  • *****
  • Posts: 1826
  • I want to show my performance at any where
    • View Profile
    • Higher Education
জীবনসংশয়ী রোগে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পরিচর্যা এবংউপশম দেওয়ার আধুনিক সমন্বিত চিকিত্সার নাম—প্রশমনসেবা বা প্যালিয়েটিভ কেয়ার। যাঁরা দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন, তাঁদের স্বজন ও পরিচর্যাকারীদের এই প্রশমন চিকিত্সার বিষয়টি জানানো এবং তাঁদের কথা শোনার জন্য ১০ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে প্রশমনসেবা দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘জেগে উঠুক আপনার কণ্ঠ’। বাংলাদেশে খুবই সীমিত আকারে দু-একটি হাসপাতালে প্রশমনসেবা আলাদাভাবে চালু হয়েছে। ব্যাপকভাবে এটি চালু করা এবংচিকিত্সক-সেবিকা-রোগী-পরিচর্যাকারী-আত্মীয়স্বজন—সবাইকে সংশ্লিষ্ট করে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। নিশ্চিত মৃত্যুকে শান্তিময় করে তোলার ক্ষেত্রে প্রশমনসেবা খুবই কার্যকর। তাই প্রশমনসেবা নিয়েআজকের ‘স্বাস্থ্যকুশল’-এর বিশেষ আয়োজন

রোগবিবরণীতে লেখা—মহিলা, বয়স: ৩০, পেশা: চাকরিজীবী, রোগ: ‘ক্যানসার’, পেটের ভেতর ছড়িয়ে পড়া ভালো হওয়ার নয় এমন ক্যানসার, চিকিত্সা পরিভাষায় ‘ওভারিয়ান সারকোমা’। দুই বছরের ইতিহাস, এর মধ্যেই দুইবার অস্ত্রোপচার, কেমো আর রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়েছে দেশে ও প্রতিবেশী দেশে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন। শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি পেট ফুলে উঠেছে। ভেতরে রক্তক্ষরণের ফলে রক্তশূন্যতায় কাগজের মতো সাদা বিবর্ণ চেহারা।
সম্প্রতি দেশের সবচেয়ে আধুনিকতম, ব্যয়বহুল হাসপাতাল থেকে তিন দিনের মাথায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তিন ব্যাগ রক্ত দিয়ে আর বেশ কিছু ব্যয়বহুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে। এরপর প্রকারান্তরে সেই অমোঘ বাণী! যা ভারতেও উচ্চারিত হয়েছিল—‘আর তো কিছু করার নেই তেমন, বাসায় নিয়ে যান।’ আসলেই কি কিছু করার ছিল না! কিছুই কি করার থাকে না!
দেশের একমাত্র প্যালিয়েটিভ কেয়ার (প্রশমনসেবা) ইউনিটে ভর্তি হলেন পারভিন হোসেন (ছদ্মনাম)। ওঁর পেট থেকে দুইবারে প্রায় ছয় লিটার রক্ত আর পানি বের করা হলো, রক্ত দেওয়া হলো কয়েক ব্যাগ, ব্যথার জন্য মরফিন ট্যাবলেট। শ্বাসকষ্ট কমেছিল, ব্যথা ছিল না, শক্তি পেয়েছিল মাঝেমধ্যেই। কিছুটা অংশ হুইল-চেয়ারে করে, এরপর বাকিটা হেঁটে কেবিনের বারান্দায় গিয়ে বসতেন।
তৃতীয় দিনের মাথায় যন্ত্রণা কমলে একটু স্থির হয়ে পারভিন যখন কথা বলতে পারছিলেন, জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বলুন তো অসুস্থ হওয়ার আগে, চাকরি ছাড়া আর কী কী করতেন? আর কী করতে ভালো লাগত—গল্পের বই পড়তে, গান শুনতে?’ ম্লান হেসে উত্তর দিলেন, ‘অফিস থেকে এসে ছেলে নিয়েই তো সময় কেটে যেত, অবসরই পেতাম না!’ যোগাযোগ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত, দক্ষ আত্মবিশ্বাসী আমি বলেছিলাম, ‘আপনার ছেলেকে দেখলাম না তো এক দিনও, কখন আসে!’ শান্ত, ধীরস্থির গলায় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আনতে ‘না’ করে দিয়েছি, এখন আর ভালো লাগে না, বিরক্ত লাগে।’ অজান্তেই মুখ ফসকে বের হয়ে এল, ‘বিরক্ত কেন?’ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন, তেমনি শান্ত ধীরগলায় বললেন, ‘ও এলে আমার বড় কষ্ট হয়, খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে…তার চেয়ে ও বরং আমাকে না দেখে দেখে অভ্যস্ত হোক।’ আমার মুখে কোনো কথা এল না আর। এরপর দীর্ঘক্ষণ মৃদু গলায় থেমে থেমে কথা বললেন নিজের কথা, পরিবারের কথা। একবার বাধা দিয়ে বলেছিলাম, ‘থাক নাহয় আজ, ক্লান্ত লাগছে আপনার, আরেক দিন শুনব।’ শোনেননি, বলতেই থাকলেন। পরদিন সন্ধ্যার রাউন্ডে ছেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। পাঁচ বছরের চঞ্চল, সপ্রতিভ ছেলেটি বারবার বলছিল, ‘আম্মু ভালো হয়ে যাবে, ভালো হয়ে বাসায় চলে যাবে, আম্মু আর কষ্ট পাবে না।’
বাসায় থাকার কথা বললেই বলতেন, ‘ভয় করে, আবার যদি ওই রকম কষ্ট শুরু হয়! তখন যদি ভর্তি হতে না পারি! আপনাদের তো তেমন বেডও নেই।’ চুপ করে শুনতাম। আসলেই তো নিয়মিত সক্রিয় কোনো ‘হোম কেয়ার সার্ভিস’ নেই আমাদের। দেশের একমাত্র প্রশমনসেবার প্রতিষ্ঠান হিসেবে অহংকার করি, অথচ রোগী যখন তার শারীরিক অবস্থার কারণে চিকিত্সাব্যবস্থার কেন্দ্রে আসতে পারে না, তখন তার আর চিকিত্সা হয় না। অথচ সভ্য সমাজের একটি চিকিত্সাব্যবস্থা তার বাসায় যাওয়ার কথা ভাবতে পারে না! কত অল্প খরচে, কত অল্প পরিশ্রমে গড়ে উঠতে পারে দেশজুড়ে একটি সমাজভিত্তিক প্রশমনসেবাব্যবস্থা। নিজের মেয়েকে ডেকে বোকার মতো প্রশ্ন করি, ‘পৃথিবীতে মোট দেশ কয়টি, বলো তো?’ আমার মাথায় খেলতে থাকে ‘অন্তত ৭০টি দেশে আট হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান প্রশমনসেবা পরিচালনা করে,’ এটা ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান। এর মধ্যে আরও কত বেড়েছে এর সংখ্যা আমার জানা নেই। যতই বাড়ুক, প্রয়োজনের তুলনায় আজও তা অপ্রতুল। গত জুনে যখন ভিয়েনায় ইউরোপীয় আন্তর্জাতিক প্রশমনসেবা সম্মেলনে চার দিন ধরে একের পর এক গবেষণালব্ধ জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনছিলাম, বারবার ভেবেছি, সরদার ফজলুল করিম স্যারের
উক্তিটি—‘মৃত্যুর মৃত্যু আছে, জীবনের মৃত্যু নেই’। প্রশমনসেবা যেন শুধু মৃত্যুকে সহনশীল করা নয়, বরং জীবনকে মর্যাদা দেওয়া। বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল, কীভাবে জীবনের গুণগত মান বাড়ানো যায় এ জীবনের প্রান্তিক সময়টুকুতে।
সম্মেলনের আয়োজন ছিল বিশাল, আনুষ্ঠানিকতায় মণ্ডিত। কিন্তু বারবার বিভিন্ন আফ্রো-এশিয়ান প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রচেষ্টার অভিজ্ঞতা উচ্চারিত হচ্ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ কোথায়! আমার দেশের নাকি অন্তত ১০ লাখ ক্যানসার রোগী, যার ৮০ ভাগই আরোগ্য-অযোগ্য, তাদের জন্য তো কোনো ব্যবস্থা নেই, আমার জানামতে। এ ছাড়া আছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত শয্যাশায়ী রোগী, কিংবা অন্য কোনো ভালো হওয়ার নয় এমন ব্যাধি; কী ব্যবস্থা আছে তাদের জন্য আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায়! অথচ দক্ষিণ ভারত, স্পেন, উগান্ডা ও দক্ষিণ আফ্রিকার কত শহরেই না এত সংগঠিত সমাজভিত্তিক আর বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশমন চিকিত্সাসেবা আক্রান্ত মানুষের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ জনের পাশে দাঁড়াতে পারে তার হূদয়ভরা মমতা আর সহমর্মিতা নিয়ে! অথচ আমরা কোথায়! সমাজের সবচেয়ে উঁচু শ্রেণী থেকে সবচেয়ে বঞ্চিত মানুষ—কারও জন্যই তো স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এ সম্পূরক বিশেষায়িত সেবাটুকুর কোনো স্থান নেই! আমাদের স্বাস্থ্য-অবকাঠামো নিয়ে গর্ব করা যায়, পরিবারসেবা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। কয়েক শ কমিউনিটি ক্লিনিক আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে। এর সঙ্গে যদি প্রশমনসেবার ধারণাটি সম্পৃক্ত করা যেত! যদি গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যেত এসব প্রান্তিক আরোগ্য-অযোগ্য মানুষের দেখাশোনা করার সংগঠিত দায়িত্ব নিতে!১০ অক্টোবর বিশ্ব প্রশমনসেবা দিবস। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ এ সেবার নতুন সদস্য। আমরা যারা সীমিত জ্ঞান আর অল্প প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু মানুষের জন্য এ প্রয়োজন মেটানোর সীমিত পরিসরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, তাদেরও একটি বিশাল স্বপ্ন আছে। শিশুর নিরাপদ জন্ম, নিরাপদ মাতৃত্ব যেমন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক দাবি, ঠিক একইভাবে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ বেদনাহীন মৃত্যু আর এর সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুপূর্ব প্রান্তিক দিনগুলোর মর্যাদাপূর্ণ জীবনদানে সহযোগিতা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একটি অংশ হয়ে উঠুক। পৃথিবীজুড়ে খুব অল্প সম্পদ ও শ্রমে এ সেবা দেওয়া সম্ভব। এর একাধিক উদাহরণ রয়েছে।
এর জন্য প্রথমে প্রয়োজন এ বিষয়ে রোগী ও তার পরিবার, সমাজকর্মী, চিকিত্সাকর্মী, সর্বোপরি নীতিনির্ধারকদের অনুভূতিগুলো আবিষ্কার করা; তাদের বক্তব্যগুলো শোনা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রশমনসেবা হয়ে উঠুক বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার।

নিজাম উদ্দিন আহমেদ
প্রকল্প সমন্বয়ক ও অধ্যাপক, প্রশমনসেবা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৭, ২০০৯
Acquire the knowledge and share the knowledge so that knowing,learning then sharing - all are the collection