শিশুখাদ্যে ভেজালের নমুনা হিসেবে মেলামিন মেশানোর দগদগে দাগ সারা দুনিয়া এখনো ভুলে যায়নি। ভেজাল খাবারের ইতিবৃত্ত বেশ পুরোনো। খাদ্যে ভেজাল তখনই ঘটে, যখন খাঁটি খাবারে অননুমোদিত কিছু মেশানো হয়। নানা উদ্দেশ্যে তা করা হয়ে থাকে।
খাবারকে ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, ছত্রাক বিভিন্ন অণুজীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে ও পচনশীলতা রোধ করে দীর্ঘদিন মজুদ রাখবে।
খাদ্য অধিকতর সুস্বাদু করার প্রত্যয়ে।
নানা জুস, ড্রিংকস ইত্যাদিতে রং মেশানো হয় শিশুদের মন ভোলাতে। এগুলো আসলে সব রাসায়নিক দ্রব্য বা কেমিক্যালস, শিশুর দেহ-মনে এসবের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া এখন প্রমাণিত সত্য এবং ইউরোপসহ বেশ কিছু অঞ্চলে এর অনেকগুলো নিষিদ্ধঘোষিত হয়েছে। বাংলাদেশে বিষয়টি কীরূপ মনোযোগ পায়, সেটিই ভাবার বিষয়।
শিশুরা কেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়
বয়স্কদের তুলনায় শিশু বয়সে খাবার গ্রহণের পরিমাণ বেশি। তারা বেশি বেশি কেমিক্যালসের সংস্পর্শে আসে।
শিশুর দেহ এসব বিষাক্ত দ্রব্য নির্বিষ করতে অপারগ। শিশুর কিডনি পুরোপুরিভাবে এসব নিষ্কাশিত করতে সক্ষম নয়।
ইনফ্যান্ট ও শিশুর বাড়ন্ত বয়সের কারণে তাদের দেহকোষ, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র অত্যন্ত সংবেদনশীল থাকে। সুতরাং এ বয়সে শারীরতন্ত্রীয় কোনো ক্ষতি হলে, তা সারা জীবনের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনে। এতে শিশু স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভেজাল খাদ্যের কেমিক্যালসগুলোর স্বরূপ
তথ্যে দেখা যায়, ডিনার প্লেটে প্রায় ২৪ রকমের কেমিক্যালস আছে, যা শরীরে ক্যানসার সৃষ্টি করে দেহে প্রবেশ করছে। নিঃশব্দে-নীরবে এর মারাত্মক বিষ বর্জ্যসামগ্রী দৈনন্দিন আহারে যুক্ত হচ্ছে, বেশির ভাগ লোক এ নিয়ে মাথা ঘামায় না।
হারবিসাইডস, পোকামাকড় মারার ওষুধ, ইঁদুর, মশা, মাছি মারার কেমিক্যালস যা ক্ষেতে শাকসবজি, ফলমূল সংরক্ষণে ব্যবহূত হয়।
বেশি মাংস ও বেশি দুধ পাওয়ার আশায় বিভিন্ন গৃহপালিত জন্তুর খাবারে নানা কেমিক্যালস দেওয়া হয়।
জন্তুর চিকিৎসা ও নিরাময়ে নানা জাতের এন্টিবায়োটিকস ও কেমিক্যালসের ব্যবহার হয়।
মুরগির খাবারে কপার সালফেট, সিসা ও আর্সেনিক মেশানো থাকে, যাতে তথাকথিত উন্নত জাতের মুরগি উৎপাদিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে খাবারের মাধ্যমে শিশুর পাকস্থলী ও অন্ত্রে শোষিত হয়ে থাকে।
অধুনা সমাজ ফাস্টফুড বেশি পছন্দ করছে। বেশি সময় টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহূত হয় মোম আস্তরণ, জলীয় দ্রবণ এবং স্প্রে। পরিষ্কার করলেও এসবের জীবাণু নষ্ট হয় না, খাবারের মধ্য দিয়ে শরীরে ঢোকে।
প্যাকেজিং প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক ফিলমসের ব্যবহার। এগুলো মাখন ও পনিরের সঙ্গে শোষিত হয়।
আরও থাকছে জিন ত্রুটি ঘটাতে সক্ষম নানা উপাদান। ভবিষ্যত্ শিশু জন্ম নেবে বিকৃত ও বিকলাঙ্গ শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে।
শিশুর শরীর-মনে প্রতিক্রিয়া
ভেজাল খাদ্যে ব্যবহূত এসব কেমিক্যালসের বহুমুখী বিষক্রিয়া রয়েছে। শিশুর দেহকোষ, মস্তিষ্ক, আন্ত্রিকতন্ত্র, রক্ত সরবরাহতন্ত্র, কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হয় খুবই বেশি। ২০০৭ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেটে যে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে শিশুখাদ্যে মেশানো নানা জাতের রং শিশুকে অতি দুরন্ত বা ডানপিটে শিশু ও অসামাজিক আচরণজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিশুর অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়। এসবের প্রতিক্রিয়া দেখা যাক।
অ্যালার্জি, অ্যাজমা, ত্বকে র্যাশ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্যে বিষক্রিয়া, শক।
বেনজাইটস: ত্বকে র্যাশ, মস্তিষ্কের ক্ষতি করে।
ব্রোমেইটস: খাবারের পুষ্টিগুণ নষ্ট করে।
বিউটি লাইলস: রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ায়। লিভার, কিডনির ক্ষতিকারক।
কেফেইন: সুগন্ধি উৎপাদনে ব্যবহূত। স্নায়বিক উত্তেজনা, বুক ধড়পড়, হার্টের অসুখ থাকলে বিপজ্জনক।
স্যাকারাইনস: আন্ত্রিক অসুখ, র্যাশ, ব্লাডার ক্যানসার।
রেড ডাই-৪০, মনো ডাইস্লিসারাইডস: জেনেটিক ত্রুটি, বিকলাঙ্গ শিশু।
ক্যারামেল: সুপ্রাণ ও রঙিন করার উপাদান। বি৬ ভিটামিন ঘাটতি, ক্যানসার জিন ত্রুটি-বিচ্যুতি।
সোডিয়াম ক্লোরাইড: রক্তের চাপ বাড়ায়, স্ট্রোক, কিডনি ফেলিওর, হার্ট অ্যাটাক।
প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ
খাদ্য ভেজালবিরোধী অভিযান ও আইনের কঠিন প্রয়োগ।
খাঁটি, টাটকা খাবার গ্রহণের মনোবৃত্তি ও প্রচেষ্টা থাকা উচিত। ফাস্টফুডস, টিনজাত খাবার শিশুকে যথাসম্ভব খাওয়ানো এড়িয়ে চলা। যেমন শিশু জন্মের পর প্রথম ও একমাত্র খাবার হিসেবে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো, ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ পান ও পরে স্বাভাবিক পারিবারিক খাবার যেমন খিচুড়ি পরিপূরক খাদ্য হিসেবে নির্বাচন করা।
যেকোনো ফলমূল খোসা ছাড়িয়ে খাওয়ানো এবং তা ভালোভাবে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নেওয়া।
শিশুকে যখন-তখন রঙিন পানীয়জাতীয় জুস খাবার খেতে দেওয়া থেকে বিরত রাখা।
টিনজাত বা কৃত্রিম খাদ্য কেনার সময় উপাদানগুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া।
প্রণব কুমার চৌধুরী
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক
শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৪, ২০১০