Author Topic: এই শতকের শীর্ষ পরিবেশ ইস্যু: একটি পর্যালোচ  (Read 3297 times)

bbasujon

  • Administrator
  • VIP Member
  • *****
  • Posts: 1826
  • I want to show my performance at any where
    • View Profile
    • Higher Education
একবিংশ শতকের প্রথম দশকে পরিবেশের সমস্যা বেশ ঘনীভূত হয়েছে, নতুন নতুন ইস্যু আবির্ভূত হয়েছে, যেসব ইস্যু ছিল, সেগুলোর কিছু পরিবর্তন ঘটেছে।

‘পরিবেশ’ ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু
২০০০—০৯ সালের মধ্যে পরিবেশ ছিল অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। গত ১০ বছরের আধুনিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশ বড় রকমের ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। রাজনীতি থেকে ব্যবসা, ধর্ম থেকে বিনোদন—সর্বত্রই পরিবেশ ছিল গণ্য বিষয়। অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য, রাজনীতি, নির্বাচন—এসব যেমন বারবার আলোচনায় এসেছে, তেমনই ইস্যু হিসেবে এসেছে পরিবেশ প্রসঙ্গও। বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন ‘সবুজ উদ্যোগে’ ব্রতী হয়েছেন, সমাজের বিভিন্ন রকমের ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র তারকা, বিজ্ঞানী, পরিবেশবাদী অনেক উদ্যোক্তা, আইনজীবী, চিকিৎসক, মিডিয়া-কর্মী, সবুজ জীবনযাপন ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নিজেদের নিয়োজিত করেছেন, আন্দোলনও করেছেন পরিবেশ সুরক্ষার জন্য।

পরিবেশ পরিবর্তন
পরিবেশ পরিবর্তন বিশেষ করে মানবসৃষ্ট উত্তপ্ত ভূমণ্ডল ছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণা, রাজনৈতিক বিতর্ক, গণমাধ্যমের আকর্ষণ এবং জন-উদ্বেগের প্রধান বিষয়। বিশজোড়া এই ইস্যুটির বৈশ্বিক সমাধানের প্রয়োজন, পরিবেশ পরিবর্তন যথার্থই পৃথিবীজুড়ে সংবেদনশীল মানুষের নজর কেড়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিশ্বের বড় বড় নেতা দেশীয় এজেন্ডাকে পাশে রেখে একটি আন্তর্জাতিক কৌশলের ভেলায় একসঙ্গে চড়ে সমাধানের পথ খুঁজতে চেয়েছেন বলে মনে হয় না। মনে হয় এত বড় এজেন্ডাটি নেতৃস্থানীয় লোকজনের উদ্যোগী হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারেনি।

জনসংখ্যা বিস্ফোরণ
১৯৫৯ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ, মাত্র ৪০ বছরে ৩০০ থেকে লোক হয়েছে ৬০০ কোটি। বর্তমান ধারা অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ৯০০ কোটিতে পৌঁছতে পারে। ফলে সারা বিশ্বে দেখা দেবে তীব্র খাদ্যসংকট, পানীয় জল ও এনার্জি-সংকট, অপুষ্টি ও রোগ বাড়বে নাটকীয়ভাবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যা যেমন—পরিবেশ পরিবর্তন, বন্য প্রাণী বিলোপ, অরণ্য ধ্বংস, বায়ু ও পানিদূষণের মতো সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

বিশ্বজুড়ে পানিসংকট
বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, ভূপৃষ্ঠে তিনজনের মধ্যে একজনের সুপেয় বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট রয়েছে। বিশ্বে জনসংখ্যা যত বাড়বে, এ সংকট তত বাড়বে। সুপেয় তাজা পানির নতুন উৎস সন্ধান করা না হলে পরিস্থিতি হবে শোচনীয়। যে পরিমাণ জল রয়েছে, একেও সঠিকভাবে ব্যবহার করা ও সংরক্ষণ করার ভালো উপায় আমরা অবলম্বন করতে পারিনি।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের শতকরা ৯৫টি নগরে পানীয় জলের নলে মিশছে মল-মূত্র ও বর্জ্য।

তেল ও কয়লা বনাম পরিচ্ছন্ন এনার্জি
গত দশকে পুনর্নবায়নযোগ্য এনার্জির ব্যবহার বেড়েছে তাৎপর্যপূর্ণভাবে। তেল ও কয়লা এখনো এনার্জির বড় উৎস হয়ে রয়েছে। বিশ্বজুড়ে তেল সরবরাহ নিঃশেষিত হওয়ার সময়টি বেশি দূরে নয়, তাই তেলশিল্পের মালিকদের সদর্প উচ্চারণ ক্রমেই স্তিমিত হবে। আমেরিকা, চীন ও অন্য অনেক দেশে এখন এনার্জি সরবরাহের উৎস হলো কয়লা, তবে এর সমস্যা রয়েছে। বিষাক্ত বর্জ্য, পরিবেশদূষণ এ ক্ষেত্রে হবে বড় সমস্যা।

সংকটাপন্ন জীবকুল
এই গ্রহে ২০ মিনিটে প্রাণীর যে প্রজাতিটির জীবন শেষ হচ্ছে, সেই প্রজাতির প্রাণী নির্মূল হয়ে যায় একেবারে, আর দেখা দেয় না এই সুন্দর পৃথিবীতে। বিলুপ্তির এই হার চলতে থাকলে এই শতাব্দীর শেষের দিকে জীবকুলের শতকরা ৫০ ভাগ হবে অন্তর্নিহিত। বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রিয় এই গ্রহে ষষ্ঠ একটি বিশাল বিলুপ্তির মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। বর্তমান বিলুপ্তির সূচনা হয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে, মানবসৃষ্ট কিছু কারণে যেমন—জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, বাসস্থানহানি, উত্তপ্ত ভূমণ্ডল এবং প্রজাতিদের নিধন ও প্রজাতিদের কেবল নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য এ হারটি বাড়ছে দ্রুত। জেফ করফিন নামের একজন খ্যাতনামা লেখকের মতে, অস্ত্র ও মাদকের চোরাকারবারির পর ইতর প্রাণীর নানা অংশের কালোবাজারি পৃথিবীর নানা স্থানে রয়েছে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে এই অবৈধ ব্যবসা যেমন—স্যুপের জন্য হাঙরের ডানা, আফ্রিকার হাতির দাঁত—এসবের ব্যবসা চলছে সঙ্গোপনে।

নিউক্লিয়ার এনার্জি
চেরনোবিল ও থ্রি মাইল আইল্যান্ডের বিপর্যয়ের নিউক্লিয়ার এনার্জির ব্যাপক ব্যবহারের ব্যাপারে আমেরিকার উৎসাহ ভাটা পড়লেও এই দশকে সে উৎসাহ ক্রমেই চাঙা হতে চলেছে। কার্বন নয় এমন উৎস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের ৭০ শতাংশ আমেরিকা পায় নিউক্লিয়ার শক্তি থেকে। অনেক পরিবেশবিজ্ঞানীর উৎকণ্ঠা এ জন্য যে পৃথিবীর এনার্জি-সংকট নিরসনেও পরিবেশ পরিবর্তনে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে নিউক্লিয়ার শক্তি বড় ভূমিকা রাখতে পারে, অথচ নিউক্লিয়ার বর্জ্য নিষ্কাশনের নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য পন্থা বা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান না করেই এমন উপায়কে পরিবেশ সমস্যা সমাধানের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করলে বিপদ বাড়তে পারে।

চীন
চীন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ, আর গত দশকে গ্রিনহাউস নির্গমনের দেশ হিসেবে এর অবস্থান শীর্ষে উঠেছে এবং কয়লাচালিত পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনে চীন আরও উদ্যোগী হলে সে অবস্থা হবে আরও শোচনীয়। বায়ুদূষণ যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, সেসব দেশের সঙ্গে চীনের যেমন যোগাযোগ, তেমনি বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর সঙ্গেও রয়েছে সংযোগ। এ ছাড়া জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যান্য এশিয়ান দেশের সঙ্গে সীমান্তপথে চীনের সঙ্গে সংযোগ, এ পথে ঘটছে দূষণের ঘটনা, এমন ব্যাপারও কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন।
তবে চীনের যে উজ্জ্বল দিক তা হলো, পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। গ্রিনহাউস নির্গমন হ্রাস করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধও হয়েছে চীন। গনগনে উজ্জ্বল বাতির ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে চীন। প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।

খাদ্যনিরাপত্তা ও রাসায়নিক দূষণ
রাসায়নিক প্রসাধনীতে থ্যালেট দেওয়া থেকে শুরু করে রান্নার তৈজসপত্রে সি-৮ এবং অন্যান্য ননস্টিক আইটেমে বিসফেনোলএ (বিপিএ) রয়েছে দৈনন্দিন বাসন তৈজসে। নিয়ন্ত্রণবিহীন, অবৈধ সব রাসায়নিক ও অন্যান্য এভিটিভ সম্পর্কে ভোক্তারা উদ্বেগে থাকেন। জিনগত প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত খাদ্যশস্য, সালমোনেলা ও ইকোলাই ব্যাকটেরিয়া-দূষিত খাদ্য, হরমোন বা অ্যান্টিবায়োটিকযুক্ত দুধ ও দুধজাত দ্রব্য, পারক্লোরেটসমৃদ্ধ শিশুখাদ্য (পারক্লোরেট রকেটের জ্বালানি বা বিস্ফোরকে ব্যবহূত হয়) খাদ্যনিরাপত্তা ইস্যু অবশ্যই।

বিশ্ব মহামারি ও সুপার বাগ
এই দশকে সম্ভাব্য বিশ্বমারী এবং নতুন ও বিনাশ-অযোগ্য ভাইরাসের ও ব্যাকটেরিয়ার উদ্ভব যেমন—এভিয়ান ফ্লু ও সোয়াইন ফ্লু নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। সুপার বাগ যাদের বলা হচ্ছে, এরা পরিবেশগত কারণের মধ্যে নিহিত। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এ ধরনের অতিপতঙ্গ বা সুপার বাগ।
প্রাণিজগতের কল্যাণে মানুষকে এই শতাব্দীর ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া পথকে বোধ করতে হবে, তা না হলে পৃথিবী থাকবে না বাসযোগ্য। এ জন্য এখনই চাই আয়োজন, তা না হলে আগামী দিনের মানুষ আমাদের কোনো দিনই ক্ষমা করবে না। যারা স্বেচ্ছায় জ্ঞানত পরিবেশদূষণের কাজে লিপ্ত থেকে এবং এই মহান ইস্যুর প্রতি নির্লিপ্ত থেকে পাপ করছে, তাদের প্রতি নির্মম হওয়া, কঠোর হওয়া দোষের কিছু নয়।

অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৬, ২০১০
Acquire the knowledge and share the knowledge so that knowing,learning then sharing - all are the collection