২০০২ সলের ঘটনা। আমি তখন ইন্টার্নি চিকিৎসক। করোনারি কেয়ার ইউনিটে সকালে স্যারদের সঙ্গে রাউন্ড দিচ্ছি; হঠাৎ নার্স চিৎকার দিল, একজন রোগীর হূদ্যন্ত্র বন্ধ হয়ে গেছে দেখে। বইয়ে পড়েছিলাম, হূদ্যন্ত্র বন্ধ হয়ে গেলে চেস্ট কম্প্রেশন (বুকে চাপ) দিতে হয়, কিন্তু হাতে-কলমে আমাদের কখনো শেখানো হয়নি কীভাবে এটা করতে হয়। সিনিয়র চিকিৎসক ত্বরিত শিখিয়ে দিলেন, কীভাবে চেস্ট কম্প্রেশন দিতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমি রোগীর বুকের মধ্যে চাপ দিতে শুরু করলাম; কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগীর হূদ্স্পন্দন শুরু হলো।
সেই প্রথম আমি সিপিআর সম্পর্কে ধারণা পেলাম। কোনো কারণে যখন হূৎপিণ্ড এবং ফুসফুস বন্ধ হয়ে যায়, তখন সাময়িকভাবে হূৎপিণ্ড ও ফুসফুসের কাজ কিছু সময় চালিয়ে মস্তিষ্কে রক্ত এবং অক্সিজেন সরবরাহ করাকে বলে ‘কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন’ (cardio pulmonary resuscitation) বা সিপিআর। উন্নত বিশ্বে সব চিকিৎসকের জন্য সিপিআর প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। শুধু চিকিৎসকেরাই নয়, নার্স, প্যারামেডিক্স, ফায়ার ব্রিগেডসহ অন্যান্য সামাজিক সংগঠন যারা দুর্যোগ মোকাবিলায় সদাপ্রস্তুত, এমনকি সাধারণ মানুষকেও এই সিপিআর নামক পদ্ধতিটি নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এত ব্যাপকভাবে সিপিআর প্রশিক্ষণ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য একটাই—জীবন রক্ষা করা, হঠাৎ করে যখন হূৎপিণ্ড ও ফুসফুস অকার্যকর হয়ে যায়, তখন আমাদের শরীরের শিরা-উপশিরায় যে পরিমাণ অক্সিজেন জমা থাকে তা দিয়ে চার থেকে ছয় মিনিট বেঁচে থাকা সম্ভব। আর সিপিআর প্রয়োগের জন্য এই চার থেকে ছয় মিনিট সময়টুকুই সবচেয়ে জরুরি। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কার্যকরভাবে সিপিআর প্রয়োগ করতে পারলে অনেককেই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্যি, শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ঘটনা হাসপাতালের বাইরে ঘটে। এদের মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ রোগী জীবিত অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী যথাযথ সিপিআর পেলে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে। ওই কারণেই চিকিৎসক ছাড়াও সাধারণ জনগণকে সিপিআর শেখানো জরুরি।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা, অনেক চিকিৎসকেরই সিপিআর সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম সিপিআর প্রশিক্ষণ চালু হয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ওমর ফারুকের (বিভাগীয় পধান, ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, বারডেম) নেতৃত্বে। বর্তমানে বারডেম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিপিআর কোর্স চালু আছে। সিপিআর কর্মশালা দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমত, বেসিক লাইফ সাপোর্ট (বিএলএস) এবং দ্বিতীয়ত, অ্যাডভান্সড কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট (এসিএলএস)। এসিএলএস শুধু বিশেষ অবস্থানে দেওয়া সম্ভব, তাই এই কোর্সটি সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু বিএলএস প্রতিটি নাগরিকের জানা উচিত। কেননা, যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো স্থানে এর প্রয়োজন হতে পারে। তাই সরকারিভাবে এই কর্মশালার আয়োজন করে সর্বসাধারণের মধ্যে, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের কাছে, সিপিআরের জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
গত সপ্তাহের মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটির বিবরণ দিয়ে শেষ করছি। পিকনিক স্পটের পুকুরে ডুবে তিনজনের করুণ মৃত্যুর ঘটনা আমাদের সবাইকে মর্মাহত করেছে।
সিপিআর কোর্সে শেখানো হয় যে কেউ পানিতে ডুবে গেলে উদ্ধারকারী যদি সাঁতার না জানে, তাহলে সে যেন কোনো অবস্থাতেই পানিতে না নামে, ওই মুহূর্তে তার কাজ হচ্ছে সাহায্যের জন্য চিৎকার করা। গাজীপুরের ওই মর্মন্তুদ ঘটনার সময় যদি স্বামী তাঁর স্ত্রীকে রক্ষার জন্য পানিতে ঝাঁপ না দিয়ে সাঁতার জানা কাউকে জোগাড় করতেন, তাহলে আরও দুটি মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হতো।
একই সঙ্গে স্ত্রীকে উদ্ধারের পর যদি তাঁকে সিপিআর দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো বা আমরা কাউকেই আর হারাতাম না।
সবশেষে বলব, এখন পর্যন্ত যে সীমিত পরিসরে বাংলাদেশে সিপিআর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তা নিতান্তই অপ্রতুল। থানা ও গ্রামপর্যায়ে যেসব চিকিৎসক, প্যারামেডিক, নার্স ও স্বাস্থ্য সহকারী কাজ করেন সিপিআর প্রশিক্ষণ তাঁদের জন্য সবচেয়ে জরুরি। কেননা দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে ওই সব স্থানে। এ ছাড়া ফায়ার ব্রিগেড ও লাইফ গার্ড ডুবুরিদের অবশ্যই প্রশিক্ষণ দরকার। সরকার অল্প খরচে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে পারে। যেহেতু সিপিআরের সুনির্দিষ্ট ধাপ ও নিয়ম রয়েছে, তাই প্রশিক্ষণ ছাড়া সঠিক কার্যকর লাইফ সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আসুন, এ ব্যাপারে গণসচেতনতা গড়ে তুলি এবং সব করুণ মৃত্যুকে প্রতিরোধ করি।
কানিজ ফাতেমা
সহকারী অধ্যাপক
ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, বারডেম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৯, ২০১১