Author Topic: শিশুর স্কুলে যেতে ভয়!  (Read 3859 times)

bbasujon

  • Administrator
  • VIP Member
  • *****
  • Posts: 1826
  • I want to show my performance at any where
    • View Profile
    • Higher Education
শিশুর স্কুলে যেতে ভয়!
« on: January 12, 2012, 06:51:15 AM »
সাত বছরের ছেলে সুমিত (কাল্পনিক নাম)। মাত্র কিন্ডারগার্টেন ছেড়ে ভর্তি হয়েছে নামী স্কুলে। কিন্তু কয়েক দিন ধরে স্কুলে যাওয়ার আগে আগে তার শুরু হয় পেটব্যথা। ব্যথার তীব্রতায় কাঁদতে শুরু করে। মা বলেন, ‘আজও নো স্কুল। অ্যাপেন্ডিসাইটিস না তো?’ বাবা বলেন, ‘মনে হয় কৃমি হয়েছে-দেখা যাক বিকেলে ডাক্তার কী বলে।’ স্কুলে যাওয়া হয় না। সপ্তাহ দুয়েক পর চিকিৎসক পেট টিপেটুপে রক্তসহ নানাবিধ পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে নিয়ে মন্তব্য করেন, ‘সব ঠিক আছে।’ তবে? ভ্রূ কোঁচকান মা-বাবা, তাঁদের চেহারায় চিকিৎসকের প্রতি আস্থাহীনতার ছাপ স্পষ্ট। প্রায় প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে কেন সুমিতের পেটব্যথা হয়? ইদানীং আবার বমি করার চেষ্টা করে, যদিও বমি হয় না। চিকিৎসক তাঁদের আশ্বস্ত করেন, ‘ভয়ের কিছু নেই, সুমিতের এ সমস্যার নাম স্কুলভীতি।’ তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠালেন সুমিত ও তার মা-বাবাকে। অল্প দিনের মধ্যেই সুমিত স্বাভাবিকভাবে স্কুল করা শুরু করল।

সুমিতের মতো সমস্যা অনেক বাচ্চারই হয়ে থাকে। সাত বছর বয়স থেকে শুরু করে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে স্কুলভীতি হতে পারে। তবে সাধারণত এ রোগের উপসর্গ শুরু হয় সাড়ে সাত থেকে সাড়ে ১০ বছর বয়সের মধ্যে। আন্তর্জাতিক গবেষণায় ধারণা করা হয়, সারা বিশ্বে স্কুলগামীদের ২ দশমিক ৪ শতাংশ শিশুর এ সমস্যা রয়েছে। প্রথম স্কুলে ভর্তির এক-দুই বছরের মধ্যে অথবা পরে কোনো কারণে স্কুল পরিবর্তন করা হলে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

স্কুলভীতির সাধারণ কয়েকটি কারণ হচ্ছে-

    জীবনে প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু করলে।
    স্কুলের বন্ধুরা কোনো কারণে উত্ত্যক্ত বা ঠাট্টা করলে, কোনো কারণে হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হলে।
    নতুন স্কুলে ভর্তি হলে-নতুন শহরে, নতুন পরিবেশে, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে না পারলে।
    নতুন শিক্ষাপদ্ধতিতে ভর্তি হলে-যেমন বাংলা মাধ্যম থেকে ইংরেজি মাধ্যমে বা ইংরেজি মাধ্যম থেকে বাংলা মাধ্যমে, সাধারণ শিক্ষা থেকে মাদ্রাসাশিক্ষায় অথবা মাদ্রাসাশিক্ষা থেকে সাধারণ শিক্ষায় হঠাৎ ভর্তি হলে।
    দীর্ঘদিন কোনো কারণে (অসুখ বা লম্বা ছুটি) স্কুলে না গেলে।
    কোনো কারণে তীব্র শোক পেলে-যেমন মা-বাবা বা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু হলে।
    পরিবারে নতুন ছোট ভাই বা বোন জ্নালে।
    স্কুলে কোনো কারণে ভয় পেলে-যেমন শিক্ষকের অতি রূঢ় আচরণ, বন্ধু বা জ্যেষ্ঠদের হাতে নিগৃহীত বা বখাটেদের উৎপাতের শিকার হলে।
    স্কুলে কোনো বিশেষ সমস্যা-যেমন বাথরুমে যাওয়া নিয়ে লজ্জা পেলে।
    পারিবারিক সমস্যা হলে-যেমন মা-বাবার নিত্যদিনের ঝগড়া, ডিভোর্স বা নিকটজনের যেকোনো ধরনের অসুস্থতা হলে।
    স্কুলে প্রতিনিয়ত খারাপ ফলাফল করলে বা স্কুলে পড়ার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে।
    পরিবারের কোনো সদস্য শিশুর স্কুলে যাওয়াকে ক্রমাগত নিরুৎসাহিত করলে, বিশেষত অতিসতর্ক মা বা বাবা অথবা দুজনই যদি সব সময় অহেতুক ভয়ে থাকে যে স্কুলে গেলে আমার সন্তান হারিয়ে যাবে বা তার কোনো ক্ষতি হবে।
    সেপারেশন অ্যাংজাইটিতে (মা-বাবাকে ছেড়ে আলাদা থাকা নিয়ে উৎকণ্ঠা) আক্রান্ত হলে।
    শিশু কোনো ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে (যেমন-বিষণ্নতা, অতিচঞ্চল অমনোযোগী শিশু, মানসিক প্রতিবন্ধী ইত্যাদি)।

শিশুর স্কুলভীতি দেখা দিলে নানা ছলছুতোয় সে স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। আর যদিও বা স্কুলে যায়, তবে সেখান থেকে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বাসায় চলে আসে। স্কুলভীতির শিশুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা স্কুলের বদলে কেবল বাসায় থাকতেই পছন্দ করে। স্কুল পালিয়ে তারা সাধারণত অন্য কোথাও যায় না। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে পেটব্যথা, বমি ভাব বা বমির চেষ্টা কিংবা বুক ধড়ফড়, অতিরিক্ত জোরে শ্বাস গ্রহণ, মাথাব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব, মাথা ঘোরা প্রভৃতি সমস্যার কথা বলে সে স্কুলে যাওয়ার সময়টুকু পার করে দেয়। স্কুলে যাওয়ার সময় পার হয়ে গেলে তার এ সমস্যাগুলো আর থাকে না। যেসব শিশুর স্কুলভীতি থাকে, বড় হয়ে তাদের কেউ কেউ উৎকণ্ঠা (অ্যাংজাইটি) বা অহেতুক আতঙ্কের (প্যানিক ডিজঅর্ডার) মতো মৃদু মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। স্কুলভীতি দূর করার জন্য মা-বাবা এবং স্কুলের শিক্ষক-সবারই সক্রিয় ভূমিকা পালন করা দরকার।

মা-বাবা যা করবেন
সন্তানকে আশ্বস্ত করতে হবে, তাকে স্কুল সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিতে হবে। যদি দীর্ঘদিন ধরে সন্তানের মধ্যে স্কুলভীতি থাকে, তবে তাকে প্রথমে স্কুল সময়ের বাইরে-যেমন বিকেলের দিকে স্কুলে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। এরপর তাকে আস্তে আস্তে স্কুলে অবস্থান করার অভ্যাস করাতে হবে-স্কুল সময়ের বাইরে ও স্কুল সময়ের মধ্যে। দিন দিন তার স্কুলে সময় কাটানোর পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং একসময় তাকে পূর্ণ সময়ের জন্য স্কুলে রাখতে হবে। পাশাপাশি এ সমস্যাটি নিয়ে শিক্ষক বা স্কুল কতৃêপক্ষের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।

প্রয়োজনে বাড়িতে তাকে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি মনোযোগ দিতে হবে। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে-স্কুলের বাইরে বাড়িতে ও স্কুলে। স্কুলবিষয়ক তার মনোভাব জানতে হবে এবং স্কুলে কোনো সমস্যা আছে কি না, তাকে কেউ বিরক্ত করে কি না, ঠিকমতো সে পড়ালেখার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে কি না সেদিকে নজর দিতে হবে। অযথা তাকে কোনো প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া যাবে না, ভালো ফল করতেই হবে এমন কোনো শর্ত বেঁধে দেওয়া চলবে না।

শিশুকে সাহস দিতে হবে এবং তাকে বোঝাতে হবে যে মা-বাবা তাকে সত্যি ভালোবাসেন। শিশুকে দৈনন্দিন রুটিন মেনে চলার অভ্যাস করাতে হবে-এমন কিছু করা যাবে না যা তাকে চমকে দেয়।

অযথা তাকে সারপ্রাইজ না দেওয়াই ভালো। তার স্কুলের সময় বাসায় এমন কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত নয়, যাতে সে নিজেকে বঞ্চিত বোধ করে। শিশুর সঙ্গে রাগারাগি করা চলবে না; তাকে মারধর যাবে না; বরং স্কুলে গেলে তাকে ছোট ছোট পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে।

স্কুল পরিবর্তন করার প্রয়োজনও হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে তার সত্যিকারের কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কি না, সে জন্য উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হবে।
স্কুলে যেতে না চাওয়া মানেই স্কুলভীতি নয়, অনেক সময় প্রকৃত শারীরিক অসুস্থতার কারণেও সে স্কুলে যেতে অপারগ হতে পারে-এ বিষয়টি ভুল গেলে চলবে না।

স্কুল কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষকদেরও রয়েছে দায়িত্ব
স্কুলভীতি রয়েছে, এমন শিশু তো বটেই এবং অন্য কোনো শিশুর সঙ্গে রূঢ় আচরণ করা ঠিক নয়। স্কুলে আসতে ভয় পায়, এমন শিশুর প্রতি বাড়তি যত্ন নিতে হবে। স্কুলে কোনো সমস্যা থাকলে-যেমন অন্যান্য সহপাঠী ওই শিশুটিকে উত্ত্যক্ত করলে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিশুর অভিভাবকদের জানাতে হবে এবং বিষয়টি নমনীয়ভাবে সমাধান করতে হবে।

প্রত্যেক স্কুলে একজন কাউন্সিলরের পদ থাকা উচিত, যিনি এ ধরনের সমস্যা সমাধানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, সে যাতে স্কুল বা এর শিক্ষকদের ভয় না পায় এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে হবে।

ক্লাসে সব ছাত্রছাত্রীকে স্মেহসূচক সম্বোধন করা প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায়, কেবল ‘তুই-তোকারি’ সম্বোধনের কারণে স্কুলের প্রতি শিশুদের বিতৃষ্ণা জ্নায়। শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য তার যেকোনো সাফল্যে উৎসাহ দিতে হবে।

আর তাঁর ত্রুটিগুলো নিয়ে যতটুকু সম্ভব কম আলোচনা করতে হবে। পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকা শিশুটির জন্য প্রয়োজনে বাড়তি যত্ন নিতে হবে এবং এ বিষয়ে মা-বাবার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।

স্কুলভীতি সাধারণ একটি সমস্যা। এ সমস্যা রয়েছে এমন শিশুকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা না করে সবার মধ্যে তাকে রেখেই তার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে, যাতে সে কোনোভাবেই হীনম্মন্যতায় না ভোগে।

স্কুলভীতি দূর করার জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের উদ্যোগই যথেষ্ট। তবে তাঁদের প্রচেষ্টা যদি ব্যর্থ হয়, সে ক্ষেত্রে সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

——————
ডা. আহমেদ হেলাল
সহকারী রেজিস্ট্রার
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
প্রথম আলো, ৯ এপ্রিল ২০০৮
Acquire the knowledge and share the knowledge so that knowing,learning then sharing - all are the collection